এস এম মনসুর নাদিম-
গত ১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমানের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে সিদ্ধান্তটির আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ করে। এখন থেকে দাওরায়েহাদিস ইসলামিক স্টাডিজ ও এরাবিকে মাস্টার্সের মর্যাদা পাবে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর চাওয়া অনুযায়ী এই প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি দেওয়া হল।২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামাশাহ আহমদ শফীসহ কওমি আলেমরা উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হেফাজতেইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘স্বীকৃতি ও সমমান দেয়ায় আপনি জাতির কাছে স্মরণীয় হয়েথাকবেন।’এদিকে কওমি মাদ্রাসার সনদকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আদালতে যাওয়ার ঘোষনা দিয়েছে ‘ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’। ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর বিবিরহাট চত্বরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক মাওলানা এম এ মতিন এই ঘোষনা দেন।তিনি বলেন-‘সরকারের বর্তমান শিক্ষানীতি যথেষ্ট ত্রুটিপুর্ন। ভোটের রাজনীতির অংশ হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে কুন্ঠিত হচ্ছেনা সরকার। উগ্রবাদী চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠি হেফাজতের সাথেও আপস করেছে। ১৭ থেকে ২০ বছর লেখা-পড়া করার পর মাস্টার্স সনদ পেতে হয়। সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তে সেখানে কওমি ধারায় মাত্র পাঁচ বছরে মাস্টার্সের সনদ প্রাপ্ত হবে’।প্রায় ১১ বছর আগে বিএনপি–জামায়াত জোটের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একই কাজ করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কওমি মাদ্রাসার সনদকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার সেই ২০০৬ সালের প্রজ্ঞাপন তার পরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেমন অনুসরণ করেনি, তেমনি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার সরকার গত আট বছরে তা বাস্তবায়ন অথবা নতুন করে পদক্ষেপ গ্রহণের কাজটি ঝুলিয়ে রেখেছিল।(সুত্রঃ প্রথম আলো ও সুপ্রভাত) দীর্ঘ এগারো বছর পর হেফাজতীদেরকে সেই পুরনো মুলাটিই টোপ হিসেবে গেলানোর বন্দোবস্ত সম্পন্ন হল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এটা আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক দুরদর্শিতার একটি কৌশল। বিএনপি একসময় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সাথে রাজনৈতিক জোট করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ট এই দেশে মুসলমানদের ভোট পেতে হলে কোন একটি ইসলামী দলকে আস্থায় আনা খুবই জরুরী। তা’ছাড়া জঙ্গিদের দমন করতে হলে শুধুমাত্র ওলামা লীগকে সাথে রাখলে চলবেনা। সাথে আরও একটি শক্তিশালী ইসলামী দল প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন দলের মস্তিষ্কে যিনি বা যারা এই বুদ্ধিটা ঢুকিয়েছেন তারা আদৌ আওয়ামীলীগের শুভাকাঙ্ক্ষী নয় অথবা তারা এই ভুলের ভয়াবহ পরিণাম বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। কারণ তারা কী জানেন, কওমি মাদ্রাসা গুলি তাদের নিজস্ব ধারায় চলে।
কওমি মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হবে ভারতের দেওবন্দির ধারায়। দেওবন্দি ধারাটি কী? ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহারানপুরে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ তাদের শিক্ষার ধারায় কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। ভারতে তাদের অনুসারী মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ বিবিসি জানায় যে দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসাটির আধুনিকায়নে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ১০০ কোটি রুপির অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছে। দারুল উলুম মাদ্রাসা বিভাগের অধিকর্তা মাওলানা আবদুল খালেক তখন বিবিসিকে বলেছিলেন যে দেড় শ বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠান কখনো সরকারি অনুদান নেয়নি—ভারতেরও না, বাইরের কোনো সরকারেরও না। তিনি বলেছিলেন, ‘দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতারাই এই বিধান করে গেছেন; কারণ সরকারের টাকা নিলে তাদের কথাই শুনতে হবে, আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারাব।’
এখন প্রশ্ন, দেড়শ বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানের ধারায় পরিচালিত এই দেশীয় কওমি মাদ্রাসা গুলিকে স্বীকৃতির সনদ দিলেই কী এরা সরকারের কথা শুনবে ? এদের তথাকথিত স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দেবে ? যদি না দেয় তবে কেন এই অসম ও প্রচলিত শিক্ষানীতির সাথে সাংঘর্ষিক এই সনদ স্বীকৃতি ? কার স্বার্থে এই খাল কেটে কুমির ঢোকানো ? গত বছরের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আল্লামা শাহ আহমদ শফী একটি চিঠি দিয়েছিলেন, যাতে তিনি স্পষ্ট করেই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান তুলে ধরেছেন। ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আমরা আপনার জ্ঞাতার্থে বিনীতভাবে আবেদন করতে চাই যে দেওবন্দের ৮ মূলনীতির ৭ নম্বর মূলনীতি হলো “এর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সরকারের অংশিদারিত্ব ক্ষতিকর।” সুতরাং সরকারের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আমাদের শিক্ষা সনদের মান দিলে তা এই মূলনীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।’এখন প্রধানমন্ত্রীর ‘আপনারা যেভাবে চান সবকিছু মিলিয়ে একটি আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে’ আশ্বাসে বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা সেই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে পারার অধিকার আদায় করে নিয়েছেন। ফলে মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যসূচি, শিক্ষার মান, পরীক্ষার পদ্ধতি,শিক্ষাদানকারী শিক্ষকদের যোগ্যতা নির্ধারণ—এগুলোর সবই করবে প্রজ্ঞাপনে যে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে সেই কমিটি। ওই কমিটিতে না থাকছেন সরকারের কোনো প্রতিনিধি, না থাকছেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডের প্রতিনিধি।
(সুত্রঃ প্রথম আলো)। পক্ষান্তরে সরকারী / বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির চিত্র ভিন্ন। সুতরাং দুটি ভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদ সমমানের হয় কীভাবে ? তাছাড়া দেশে জঙ্গিবাদিতায় জড়িত বেশিরভাগ জঙ্গি কওমি মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা লাভ করেছে বলে বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ। অতিসম্প্রতি ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী মুফতি হান্নান ও কওমি ধারায় লেখা পড়া করেছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় জঙ্গি হামলায় কওমিদের সম্পৃক্ততার প্রমান পাওয়া গেলেও তাদের শাস্তি না দিয়ে সরকার কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনেও যে নির্বাচনী রাজনীতি মূল কারণ, তাতে সন্দেহ নেই। ২০১৮–এর শেষ নাগাদ যে নির্বাচন হওয়ার কথা, তাতে শুধু বামপন্থী মিত্রদের ভোট আওয়ামী লীগের জন্য যথেষ্ট নয়। এই উপলব্ধি থেকেই ইসলামপন্থীদের ভোট যেভাবে যতটা বেশি সম্ভব নিজেদের দিকে টানার প্রয়োজনীয়তা আওয়ামী লীগ অনুভব করছে। শুধুমাত্র ভোটের জন্য এহেন এক বিতর্কিত ছাড় ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগকে কঠিন সমালচনার সম্মুখীন করবে যা অনুতাপের শেষ সীমা হবে। সাথে সাথে মনে রাখতে হবে কওমি’রা কস্মিনকালেও নৌকায় চড়বেনা। আওয়ামীলীগ যদি মনে করে তারা ভোটের সময় হেফাজতের সহানুভূতি বা সমর্থন পাবে তবে সেটা আওয়ামীলীগের অলীক কল্পনা !একসময় ইসলামী পন্থি ভোটের আশায় বিএনপি জামায়াতের সাথে জোট করে যেই ভুল করেছিল তার চরম খেসারৎ এখনো দিতেছে দলটি। সেই একই ভুলের পথে হাঁটছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল অসাম্প্রদায়িক চেতনার দল বলে প্রচারিত আওয়ামীলীগ। সুন্নী সংখ্যাগরিষ্ঠের এইদেশে সুন্নীরাই বেশিরভাগ আওয়ামীলীগকে ভোট দেয়। ভোটের রাজনীতিতে সুন্নীদের সাথেই হাত মিলানো ছিল উচিৎ বলে অনেকের মতে সময়ের দাবি। সুন্নীরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছে। জামায়াত আর হেফাজত এ টিম আর বি টিম। জামায়াত নিষিদ্ধ। জামায়াতীরা হেফাজতের জার্সি গায়ে তুলে দিব্যি রাজনীতি করবে আর সাধারন মানুষ চেয়ে চেয়ে শুধু চোখের জল ফেলবে।
লেখক: এস এম মনসুর নাদিম
সাংবাদিক ও কলাম লেখক।