কমছে পানি বাড়ছে দুর্ভোগ!

0

সাইফুল উদ্দীন, রাঙামাটি প্রতিনিধি::কাপ্তাই হ্রদের পানি কমতে শুরু করেছে। সাধারণত অক্টোবর মাসের পরে তেমন কোনো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হ্রদের রিজার্ভ(সংরক্ষিত) পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ছাড়তে হয়। আবার জলেভাসা জমিতে চাষাবাদের জন্যও হ্রদে প্রচুর পানি ধরে রাখাও সম্ভব হয় না। সব মিলিয়ে চৈত্রের পর থেকেই পানি কমে যাওয়া ও হ্রদে প্রচুর পলির কারণে রাঙামাটির সাথে উপজেলাগুলোর নৌপথে যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি হয়। পণ্য পরিবহনসহ যাত্রীদের প্রচুর দুর্ভোগ পোহাতে হয় এসময়। কাপ্তাই হ্রদে পলি জমে গভীরতা কমে যাওয়ায় এই দুর্ভোগের মাত্রা বেশি বলে জানা যায়। অতিরিক্ত পলির কারণে সামান্য পানি কমে গেলেই দুর্গম অঞ্চলে চলাচলে সমস্যা দেখা দেয়। গবেষকদের ভাষ্যমতে আয়তনের দিক থেকে হ্রদটির গভীরতা বর্তমানে অর্ধেকের চেয়ে বেশি কমে গেছে। এতে প্রায় চার মাসেরও অধিক সময় উপজেলাবাসীকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়। বিভিন্ন সময় কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিংয়ের কথা বলা হলেও এখনো কোনো সুসংবাদ পাচ্ছে না জেলাবাসী।

আজ থেকে প্রায় ৬৭ বছর আগে বাঁধ নির্মাণের সময় এখানকার বিশাল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে লক্ষাধিক অধিবাসী ভূমি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বাঁধ দেওয়া হলেও পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বনজ সম্পদ আহরণ, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, পানিপথ উন্নয়ন, নৌযোগাযোগ স্থাপন এবং মৎস্য উৎপাদনের বিষয়টিও তখন থেকেই বিবেচনায় ছিল। হ্রদটির সৃষ্টি এ এলাকার লক্ষাধিক অধিবাসীর জন্য অভিশাপ বয়ে আনলেও এই হ্রদ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উম্মুক্ত করে দেয় নতুন এক সোনালী সম্ভাবনার দিগন্ত। পাশাপাশি নৌপথে উপজেলার সাথে যোগাযোগও সহজ হয়। অপরূপ সৌন্দর্য্য ও নয়নাভিরাম হ্রদটি দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ছুটে আসেন। এই হ্রদ ঘিরেই পর্যটন খাত থেকে আয় হয় কোটি কোটি টাকা। কিন্তু এই হ্রদ ব্যবস্থাপনার জন্য বিগত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়ে যেমন সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি, তেমনি এর রক্ষণাবেক্ষণ ও ক্ষয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য কোনো সমন্বিত উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।

এর মাঝেই পাহাড়ি ঢলের কাদা মাটি, পলি মাটি, বিষাক্ত বর্জ্য, আবর্জনা ফেলে হ্রদটিকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এখনই উদ্যোগ না নিলে আগামী দু’দশকের মধ্যেই হ্রদটি আর কর্মোপযোগী থাকবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে রাঙামাটির সাতটি নৌপথে উপজেলার সাথে সদরের যোগাযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কাপ্তাই, নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়িতে সড়কপথ থাকলেও বাকী চারটি উপজেলা বরকল, জুরাছড়ি, লংগদু ও বিলাইছড়ির সাথে সরাসরি নৌপথে আসা-যাওয়া করতে হয়। ইতোমধ্যে জুরাছড়িতে সরাসরি কোনো লঞ্চ বা বোট যেতে পারছে না। প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরে রাস্তার মাথা পর্যন্ত বোট যাওয়া আসা করছে। এদিকে বাঘাইছড়িতেও সরাসরি কোনো লঞ্চ যেতে পারছে না। লংগদুরের মাইনি পর্যন্ত যাওয়ার পর ছোট বোটে দুরছড়ি ও বাঘাইছড়ি যেতে হচ্ছে। এছাড়া পানি কমে যাওয়ায় বিলাইছড়িতে পণ্য পরিবহনে প্রচুর সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

পরিবেশবাদীদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ নিধন, জুমচাষের ঐতিহ্যবাহী পন্থা পরিহার করে যেভাবে ইচ্ছা পাহাড় কর্ষণ ও চাষ এবং পাহাড় কেটে বসতি স্থাপনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কাপ্তাই হ্রদের ওপর। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক কারণের চেয়ে মানবসৃষ্ট কারণগুলোকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করেছেন তারা।

হ্রদ এলাকার শহর ও বাজারে স্থাপিত স’মিল, ফিলিং স্টেশন, জেটি ঘাট, বাস-ট্রাক টার্মিনাল এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ আবাসিক এলাকার বর্জ্য ও আবর্জনা হ্রদে ফেলা হচ্ছে। এতে বিভিন্ন স্থানে পলির মাত্রাও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে এলাকার চাষাবাদ, মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। নৌচলাচলও বিঘ্নিত হচ্ছে।

লঞ্চ চালক ও যাত্রীরা জানায়, প্রতিবছর চৈত্র থেকে আষাঢ় পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে পানির অভাবে প্রচুর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জেলার উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও উপজেলার সাথে যোগাযোগ সহজ ও নির্বিঘ্ন রাখার জন্য যে উদ্যোগ তা চোখে পড়ছে না। জনপ্রতিনিধিরা দ্রুত কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং শুরুর আশ্বাস দিলেও এর কোনো কার্যক্রম চোখে না পড়ায় হতাশ ব্যক্ত করেন ভুক্তভোগীরা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.