চট্টগ্রামে উত্তর-দক্ষিন বিএনপিতে খালেদার এ্যাকশান

0

জুবায়ের সিদ্দিকী-  চট্টগ্রামে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক গাজী শাহজাহান জুয়েল ও উত্তর জেলার সদস্য সচিব কাজী আবদুল্লাহ আল হাসানকে দলীয় দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত ১৮ মে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক বেলাল আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় গঠনতন্ত্রের ৫ (গ) ধারায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। দলীয় সুত্র মতে, গত ২ ও ৩ মে অনুষ্টিত চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির পৃথক কর্মীসভায় সংঘর্ষের ঘটনায় দুই নেতাকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে এ শাস্তিমুলখ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির কর্মীসভায় সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে এর একদিন আগে অভিযুক্ত দুই নেতা সহ চট্টগ্রামের অন্য নেতাদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সফরে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও। বৈঠকে চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুল্লা আল নোমান, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, এস.এম ফজলুল হক, গোলাম আকবর খন্দকার, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, ডা. শাহাদাত হোসেন, গাজী শাহজাহান জুয়েল, এনামুল হক এনাম ও মাহবুবুর রহমান শামীম অংশ নেন।

বৈঠকে উপস্থিত নির্ভরযোগ্য সুত্র মতে জানা যায়, দীর্ঘ আড়াই ঘন্টার এ বৈঠকে উত্তর ও দক্ষিণ জেলার সংঘর্ষের ঘটনায় গাজী শাহজাহান ও কাজী হাসানের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন চেয়ারপারসন। প্রথমে দক্ষিণ জেলার সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ সময় জেলার সহ-সভাপতি এনামের কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে তার শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন চেয়ারপারসনকে দেখান। শাহজাহান জুয়েল সংঘর্ষের সময় তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে না আসা এবং হাসপাতালে দেখতে না যাওয়ার কথা বলেন তিনি। জেলার দায়িত্বশীল নেতাদের সম্মতি না নিয়ে হঠাৎ করে কর্মীসভার ভেন্যু পরিবর্তনের বিষয়টিও তিনি চেয়ারপারসনের কাছে তুলে ধরেন।

পরে বিএনপি চেয়ারপারসন ক্ষুদ্ধ হয়ে এসব অভিযোগের বিষয়ে শাহজাহান জুয়েলের কাছে কৈফিয়ত চান। কিন্তু তিনি সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে পারেননি। এর পর উত্তর জেলা বিএনপির কর্মী সমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনায় কাজী হাসানের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার প্রশ্ন তুলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সভায় নেতাকর্মীদের সমন্বয় করতে না পারা নিয়ে তার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। পরে চট্টগ্রামের নেতারা বিভিন্ন মতামত দেন। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন,’আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাতে আপনারা একমত আছেন কিনা? উত্তরে নেতারা সম্মতি দেন। চেয়ারপারসন তখন সিদ্ধান্ত পরে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে বৈঠকে জানান।

সুত্র মতে, বৈঠক চলাকালে গুলশানের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা দুই নেতাকে দল থেকে বহিস্কার আদেশের খসড়া লিখে আনেন। এটা দেখে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী উপস্থিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে প্রশ্ন রাখেন,’এখন কি আমাদের বহিস্কার আদেশের মৌসুম? তখন মির্জা ফখরুল বিষয়টি নিয়ে বৈঠক শেষে চেয়ারপারসনের সাথে একান্তে আলাপ করেন। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন তাদের দলীয় দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দেন। এদিকে উত্তর ও দক্ষিনের দুই নেতার পাশাপাশি বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীমের সাংগঠনিক কর্মকান্ড নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে তাকে শাসিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন।

চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলার কর্মী সভায় বিশৃঙ্খলার পেছনে নেতাদের সমন্বয় করতে না পারার জন্য ধমক দিয়ে সতর্ক করে চেয়ারপারসন বলেন’ ভবিষ্যতে যাতে এমন না হয়’। বহিস্কারাদেশের বিষয়ে কাজী আবদুল্লাহ আল হাসান বলেন,’ আমার কোন দোষ ছিল না। এরপরও চেয়ারপারসন দলের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমি মেনে নিয়েছি। গাজী শাহজাহান জুয়েলের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এদিকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এনামুল হক এনাম বলেছেন, কর্মীসভায় যোগদানের সময় বিনা কারনে তাকে জুয়েলের নির্দেশে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে এবং তার অনুসারীদের মারধর করা হয়। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়টি আমি দলের চেয়ারপারসন ও শীর্ষ নেতাদের অবহিত করেছিলাম। আমি কোন মামলা করিনি।

তবে জুয়েলকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় আমি হামলার বিচার পেয়েছি। পটিয়ার সাবেক এমপি গাজী শাহজাহান জুয়েলের অনুসারী উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, দলের চেয়ারপারসন যে সিন্ধান্ত নিয়েছেন তা অবশ্যই সকলকে মানতে হবে। তবে সকল আন্দোলন সংগ্রামে পটিয়ায় জুয়েল ভাইয়ের অবদান রয়েছে। আশা করছি অব্যাহতির বিষয়টি শীঘ্রই প্রত্যাহার করে নেবেন। গত ৩ মে পটিয়ায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির কর্মী সমাবেশে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক গাজী শাহজাহান জুয়েল ও সহ-সভাপতি এনামুল হক এনামের অনুসারীদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে এনামুল হক এনাম গুরুতর আহত হন।

এ ছাড়ার তার আরও ৩০ জন নেতাকর্মী আহত হন। এর আগে নগরীর নাসিমন ভবন দলীয় কার্যালয় চত্বরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির কর্মী সমাবেশে দুপক্ষের নেতাকর্মীদের মারমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘক্ষন ধরে চলা এ সংঘর্ষে বাঁশের আঘাতে সীতাকুন্ড উপজেলার দুই ছাত্রদল নেতার মাথা ফেটে যায়। আহত হয় আরও ৮ জন। বেপরোয়া কর্মীদের উত্তেজনার কারনে চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তড়িগড়ি করে সভা ত্যাগ করেন।

এদিকে পটিয়া উপজেলার রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। পটিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক গাজী শাহজাহান জুয়েলকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়াতে সেখানকার রাজনীতির মোড় ঘুরে গেছে। সাবেক সাংসদ জুয়েলের একছত্র আধিপত্যে ধ্বস নামায় পটিয়ার বিএনপির রাজনীতি চলে গেছে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এনামুল হক এনামের হাতে। জুয়েল ও এনাম দুজনই পটিয়ার বাসিন্দা। পটিয়া বিএনপিতে দুই নেতা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন গাজী শাহজাহান জুয়েল। ২০১১ সালে তিনি জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক পদে আসীন হন। পটিয়া থেকে পরপর দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সেখানে তার দুর্গ গড়ে উঠে।

জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদ হওয়ার পর সেখানে তার আধিপত্য বেড়ে যায়। জুয়েলের একক আধিপত্যের কারনে এনাম ছিলেন কোণঠাসা। তবে এনাম জেলার সহ-সভাপতি হওয়ার পর সেখানে তার কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেন। কিন শাহজাহান জুয়েল গত ছয় সাত বছর ধরে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকান্ডে নিস্ক্রিয় থাকেন। তিনি প্রায় সময় থাকতেন ঢাকা ও কানাডায়।

এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচিত হন জুয়েল। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসনও তার এমন ভুমিকায় অসন্তোষ ছিলেন। এ প্রসঙ্গে এনামুল হক এনাম,’ নেত্রী সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এর মাধ্যমে তিনি মেসেজ দিয়েছেন, কেউ যাতে সামনে এমন সংগঠনবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত না হন। তিনি আরও বলেন,’জুয়েল যখন এমপি ছিলেন তখন রাজত্ব ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পটিয়ায় আমার রাজনৈতিক অবস্থান পাকাপোক্ত। আমি তৃনমুলের সাথে সম্পৃক্ত, যা জুয়েলের নেই’’। তবে শাহজাহান জুয়েলের অনুসারী পটিয়ার একজন বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন,’নেতৃত্বে না থাকলে তো আধিপত্য থাকে না। এটা বাস্তবতা। স্বাভাবিকভাবে পটিয়ায় বিএনপির রাজনীতির মোড় ঘুরে যাবে।

শাহজাহান জুয়েল পটিয়ায় কর্মী সভার ভেন্যু স্থানান্তর করে নিজের ফাঁদে নিজে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। অপরদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আদেশ উপেক্ষা করে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদ্য অব্যাহতি প্রাপ্ত বিএনপি নেতা গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান জুয়েল নিয়মিত সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে এবং গ্রুপিং জিইয়ে রেখে তার অনুসারী নেতাকর্মীদের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় সভা করে যাচ্ছেন।

এরপরও প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে তিনি দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে গ্রুপিং জিইয়ে রাখার মিশনে নেমেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী। তাদের মতে, দলের অব্যাহতি আদেশ অমান্য করেই প্রতিদিন জুয়েল নগরীর চান্দগাঁওস্থ বাসভবনে তার অনুসারী বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.