চট্টগ্রামে দিয়াজ মার্ডার : থলের বিড়াল বের হয়ে আসছে

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটিনিউজ ::  ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ন সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী আত্বহত্যা করেননি, তাকে শ্বাসবোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিয়াজের দ্বিতীয় ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকের বরাত দিয়ে গত ৩০ জুলাই এ কথা জানিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর। দিয়াজ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন বলেন,’ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এখনও হাতে পাইনি।

তবে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, দিয়াজের মৃত্যু শ্বাসরোধজনিত হত্যাকান্ড’’। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে দিয়াজ সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত বছরের ২০ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯ টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকার বাসায় তার ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়। এ সময় বাসায় কেউ ছিলেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২নং গেট এলাকায় চার তলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন দিয়াজ ও তার পরিবারের সদস্যরা। তারা যে ভবনে থাকতেন এটি ছিল নির্মানাধীন। তখন তার স্বজনরা অভিযোগ করেছিল, পরিকল্পিতভাবে দিয়াজকে হত্যা করার। তাদের মতে, দ্বিতীয় তলায় একটি জানালা রয়েছে যেটি দিয়ে সহজেই একজন লোক গমনাগমন করতে পারে। তা ছাড়া বাসার বাইরে একটি মইও পড়েছিল। বাসার দরজায় ছিল ডিজিটাল লক সিস্টেম।

দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করে পুলিশ লাশ উদ্ধার করলেও বলা হয়েছিল, যে কেউ ভেতর থেকে দরজা লক করে বের হয়ে গেলে চাবি ছাড়া খোলার কোন অবকাশ নেই। এসব সুযোগ কাজে লাগিয়েই দুস্কৃতকারীরা দিয়াজকে হত্যা করে লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুঁলিয়ে রেখে পালিয়ে গেলে বলেই সন্দেহ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। লাশ উদ্ধারের সময় হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আফসানা বিলকিস ও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় দিয়াজের মা জোবায়দা আমিন চৌধুরী প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন,’ আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। যারা খুন করেছে তারা এর আগে আমার ঘরে হামলা করে ভাঙচুর-লুটপাট করে’। লাশ উদ্ধারের পর দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও দিয়াজকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবী করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার নিয়ে জটিলতার জেরেই এ হত্যাকান্ড বলেও তারা জানিয়েছিলেন।

এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম ময়নাতদন্তের পর ২৩ নভেম্বর চিকিৎসকরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এ সহ-সম্পাদক আত্মহত্যা করেছেন বলে জানান। কিন্তু ওই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যাজিষ্টেট শিবলু কুমার দে’র আদালতে দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু সহ ১০ জনকে আসামী করা হয়। আদালত সরাসরি মামলা গ্রহন করে সিআইডিকে তদন্তের আদেশ দিয়ে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে সিআইডি দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্তের উদ্যোগ নেয়।

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর কবর থেকে দিয়াজের মরদেহ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেয়। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর কবর থেকে দিয়াজের মরদেহ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীর প্রধান সোহেল মাহমুদকে প্রধান করে গঠিত তিনজনের টিম পুন: ময়না তদন্ত করেন। বাকি দুই চিকিৎসক হলেন প্রদীপ বিশ্বাস ও কবির সোহেল। প্রায় আট মাস পর এলো এই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা দিয়াজের দেহে জখম পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। দিয়াজের মা জাদো আমিন চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন,’আমার ছেলেকে তারা অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছে। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে। প্রমানিত হয়েছে এখনো পৃথিবীতে ভাল মানুষ আছে। আমি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আমি নিতান্তই সাধারন মানুষ। খুনীদের মতো কোটিপতি নই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা’। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে দিয়াজের মা বলেন,’ ২২ ঘন্টার মধ্যে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেতে কেউ দেখেছেন? পুলিশের কাছে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যাওয়ার আগে টিপুরা সংবাদ সম্মেলন করে, বিবৃতি দিয়ে বলে রিপোর্ট তাদের হাতে এসেছে। দিয়াজ আত্মহত্যা করেছে’। তিনি অভিযোগ করেন,’ মামলা তুলে ফেলার জন্য তারা একাধিকবার আমাকে হুমকি দিয়েছে, বলেছে না তুললে আমাকে আর আমার মেয়েকে দিয়াজের মতো নির্যাতন করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে’।

দিয়াজের মা জানান, তার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন। দিয়াজের বড়বোন আইনজীবী সাঈদা ছরওয়ার বলেছেন,’ যারা প্রথম রিপোর্টটাকে প্রভাবিত করেছে, তারা সেকেন্ড রিপোর্টটাকেও প্রভাবিত করতে চেয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কঠোর মনিটরিং এর কারনে তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীরও নজরদারি ছিল। চিকিৎসকদের আন্তরিকতার কথাতো বলতেই হবে। ডাক্তার নিজেও ষ্ট্রং ছিলেন। তিনি প্রথম থেকেই আমাদের বলে দিয়েছেন যে কারো হুমকি ধমকিতে ভয় পাই না। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখলাম আমরা প্রথম থেকে যেটা বলে আসছি সেটাই প্রমানিত হলো। দিয়াজের বোন বলেন, আমার ভাইকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এটা খুবই মর্মান্তিক।

শুধু সান্তনা এটাই যে, তার মৃত্যুর প্রকৃত কারনটা বেরিয়ে এসেছে। আমার ভাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। যারা আমাদের ঘর ভাংচুর করছে, যারা দিয়াজকে হত্যা করেছে, যারা দিয়াজের হত্যা নিয়ে অপরাজনীতি করছে, অপপ্রচার চালিয়েছে, তাদের সকলের বিচার আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে দাবী করছি। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত কর্মকর্তা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা, সোহেল মাহমুদ প্রতিবেদনের বিষয়ে কিছু বলতে রাজী হননি। তবে তিনি বলেন,’সিআইডি আমাদের কাছ থেকে প্রতিবেদন নিয়ে গেছে’।

প্রসঙ্গত অভিযোগ উঠেছিল, ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে কোন্দলের জের ধরে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। দুটি ভবন নির্মানে প্রায় ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডারকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে কোন্দল চরম আকার ধারন করে। এর আগে দুই মাসে অন্তত পাঁচবার দুপক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।

এর মধ্যে রয়েছে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান গ্রুপ ও সভাপতি আলমগীর টিপু গ্রুপ। সর্বশেষ গত বছরের ২৯ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবদুর রব হলের সামনে কুপিয়ে আহত করা হয় সহ-সভাপতি তাইফুল হক তপুকে। এর পর ক্যাম্পাসের ২নং গেটে দিয়াজের বাসাসহ ছাত্রলীগের চার নেতার বাসায় তান্ডব ও লুটপাট চালানো হয়। হামলার এসব ঘটনার সঙ্গে দরপত্রের ভাগ বাটোয়ারার বিষয়টি জড়িত বলে জানা গেছে। এসব কারনে ২৬ ও ২৭ সেম্পেম্বর ক্যাম্পাসে অবরোধের ডাক দেয় ছাত্রলীগের একটি পক্ষ।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.