চট্টগ্রামে পোস্টার ও মেজবানের রাজনীতি

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটিনিউজ :: রাজনীতি এখন এক জমজমাট ব্যবসা। এ দেশে একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিবিদরা গৌরবের সঙ্গে পেশা হিসেবে পরিচয় দিতেন রাজনীতি। এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। জাতীয় সংসদের প্রায় ৮০ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী। প্রবীন ও নবীন অনেক পেশাদার রাজনীতিবিদও সরাসরি বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। আবার অনেকে নামে বেনামে স্বজনদের সঙ্গে ব্যবসায় সংযুক্ত আছেন। মাঠ থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একই অবস্থা। এমনকি ডান বাম সব ধরনের নেতাই এখন ব্যস্ত ব্যবসায়।

ক্ষমতাসীন বা বিরোধীদলে যোগ দিয়ে রাজনীতির খাতায় যোগ হচ্ছেন ব্যবসার জন্য তবে ডাল হিসেবে ব্যবহার করছেন রাজনীতি। ছাত্র, যুব ও সকল পর্যায়ের রাজনীতির একই চিত্র। এমপি হওয়ার পর পাল্টে গেছে কারও কারও পেশাও। ব্যবসায়ী থেকে শিল্পপতি। আগে ব্যবসা না করলেও এমপি হয়ে এখন শিল্পপতি। নামে বেনামে রয়েছে তাদের অকাধিক ব্যবসা প্রতিষ্টান। আগে রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতেন জনগনের কল্যানে।

এখন সবাই রাজনীতিবিদ হয়েছেন নিজেদের কল্যানের জন্য। রাজনীতিকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহন করছেন। দশম জাতীয় সংসদের এমপিদের প্রায় সবাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেকে নিজেদের হলফনামায় রাজনীতিবিদ উল্লেখ করলেও বাস্তবে তারা পুরোপুরি ব্যবসায়ী। ৩৫০ এমপির হলফনামা বিশ্লেষন করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকবর্গ জানান, বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিকই ব্যবসায়ী। তারা রাজনীতি করছেন ব্যবসায় কিছু সুযোগ সুবিধা পেতে। আবার অনেকে শখের বসে রাজনীতিতে জড়িয়ে ব্যবসায়ী হয়ে যান। পুর্বের আর এখন রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেক তফাত।

তাদের মতে, রাজনীতি হচ্ছে সমাজের চালিকাশক্তি। একটা সমাজ কোন ধরনের নীতি আদর্শের ভিত্ত্বিতে চলবে এবং শাসন ও অর্থনীতি, শিক্ষা-সাংস্কৃতি সবকিছু আবর্তিত হয় রাজনীতিকে ঘিরে। এর ফলে রাজনীতি যদি নীতি ও আদর্শবর্জিত হয় তবে জাতি ও রাষ্ট্রকে মাশুল গুনতে হয়। লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে। জনগনের প্রত্যাশা ধুলায় লুন্ঠিত হয়। রাজনীতি থেকে যত নীতি বিসর্জন হবে ততই সেখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটবে। একে একে দুর্বৃত্তদের হাতে রাজনীতি চলে যাবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকে একদল লোক ব্যবসা হিসেবে নেবে। অনেকে মনে করেন, রাজনীতিবিদরা ঠেকায় পড়ে ব্যবসায়ী হয়ে যান। টাকা দেখাতে না পারলে মনোনয়ন পাওয়া যায়না। নেতাকর্মী লালন পালন করা যায় না।

একারনে ব্যবসাকে আড়াল করে রাজনীতির মাট চষে বেড়ান অনেক রাজনীতিবিদ। স্বাধীনতাপুর্ব সময়ে যারা রাজনীতিকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন তাদের সমাজে একটা মর্যাদা ও সম্মান ছিল। কারন তারা দেশের জন্য কাজ করেছেন নি:স্বার্থভাবে। এদের সংখ্যা এখন কম। বেশিরভাগ সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পেশাগত রাজনৈতিক নয়। তারা ব্যবসায় রাজনীতির আড়ালে নয়ছয় এর হিসাব করেন দুর্নীতির মাধ্যমে। অনেক লোকদের সংখ্যাই এখন বেশি। রাজনীতির মাঠ এখন এদের দখলে। একারনে সমাজে অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। আগে রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা এখন হারিয়ে গেছে। আগে জেলখানায় যাওয়া ছিল সম্মানের। এখন জেলখানায় যাওয়া হয় দুর্নীতির খতিয়ান বগলে নিয়ে। কারন এখন দুর্নীতির কারনেও রাজনীতিবিদরা জেলখানায় যাচ্ছেন। রাজনীতির সুস্থ ধারা ব্যাহত হচ্ছে দেশে বারবার।

যারা জনগনের প্রতিনিধি তারা সম্মানের পাত্র হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যখন দেখি আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জনগনের ধারে কাছে না গিয়ে নিজেদের ব্যবসা বানিজ্য নিয়েই ব্যস্ত। নির্বাচন এলেই এরা মানবদরদী ও জনদরদী হলেও সারা বছরে তাদের ছায়াও জনগন দেখে না। অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নানাভাবে তদবিরে মনোনয়ন লাভ ও নির্বাচনে কালো টাকা ছড়িয়ে দলীয় ভাবমুর্তিকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রতিনিধি হয়ে যাওয়ার পর আবার ফিরে যান যান পুরোদস্তর ব্যবসায়ী হিসেবে। আজ সিঙ্গাপুর কাল কানাড়া এরপর রাজনীতিতে তারা হয়ে উঠেন ব্যস্ত। ভুলে যান নিজ এলাকার মানুষকে। দেখা করতে গেলে আবার অনেকে জিঙ্গেস করেন,’অ-বাজি আঁরে ভোট দিয়্যুনা। কোন বাড়ির, কার পোয় তুঁই। কিল্লাই আইস্যছ’।

অর্থাৎ তিনি তার ভোটারকে চেনেনই না। এখন চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে, ব্যানার, পোষ্টার ও মেজবানের রাজনীতি। পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে শহর। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার ব্যানার হেড স্লোগান, বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে নিজের ছবি লাগিয়ে ব্যানার, ফ্যাস্টুন ও পোষ্টারে রঙ্গিন করে যেন নির্বাচনি আমেজ ফিরিয়ে এনেছিল মৌসুমী নেতারা। নিজেকে জানান দিতে, পরিচিতি করতেও বঙ্গবন্ধুর নাম ও ছবি ব্যবহার করছে এসব এমপির খায়েশ হওয়া নেতারা। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে টাকার ছড়াছড়ি। মা বাবা, দাদা-দাদীর মেজবানের নামে চলছে রাজনীতির মহড়া।

নির্বাচনী প্রচারনা। চট্টগ্রাম শহরে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদল এর সংসদ সদস্য প্রার্থী হতে আগ্রহীরা এখন দেড়বছর নির্বাচনের সময় থাকলেও মাঠে নেমে পড়েছেন জনদরদী, মানবদরদী ও সমাজ সেবক হয়ে। দুই দলেই আছে বুর্জোয়া, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, সন্ত্রাসী, গড়ফাদার ও কালো টাকার মালিক। এরাই এখন মানুষকে শেখায় রাজনীতি ও সমাজনীতি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদলে অনেক ব্যবসায়ী, শিল্পপতি,ধান্ধাবাজ, বদমেজাজী, চাঁদাবাজ এবার মনোনয়ন প্রত্যাশা করে রাজনীতি করছে ব্যানার, ফেষ্টুন ও মেজবানকে কাজে লাগিয়ে। চট্টগ্রামের রাজনীতির মানচিত্রে ক্ষমতাসীনদলে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার খায়েশ নিয়ে শহরে নানা ইস্যুতে ভরে যাচ্ছে রঙ্গিন ব্যানার, ফেষ্টুন ও পোষ্টারে। ক্ষমতাসীন দলের চাঁদাবাজ, বুর্জোয়া, অসৎ ব্যক্তি, ধান্ধাবাজদেরও দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে।

এক নেতা বললেন, ’আঙ্গো নেতা এইবার নমিনেশন পাইব। হেথে মন্ত্রী এক ডজনের লগে ফোর ফ্িট্ট ভোল্টেজে লাইন লাগাইছে। আঁন্নে কি ২২০ ভল্টেজে মনে কইরছেন নি’। নগরীর প্রাণকেন্দ্রের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও নেতা বললেন, ’আঁরার নেতা নমিনেশন পাইব। ট্যায়া নো মেটার। ট্যায়া কামাইয়ে খরচ গবির। যে পথে সৃষ্টি সে পথে বিনাশ। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। এদের অনেকের আচার ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। আগে মেজাজ ও অহংকার দেখালেও এখন যেন মাটির মানুষ। বিচিত্র এই দেশ। বিচিত্র মানুষ। সেলুকাস।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.