চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা বাড়ছে

0

মো. দেলোয়ার হোসেন,চন্দনাইশ::মাহিন্দ্রা ও নাম্বারবিহীন সিএনজি টেক্সী যাত্রীবাহী পিকআপে লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান মহাসড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও ট্রাফিক, হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের কোন নজর নেই। ফলে প্রাণ হারাচ্ছে মহিলা, শিশু, শিক্ষার্থীসহ অনেকে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৫ মে বিকালে সড়কের পাঠানীপুল এলাকায় যাত্রীবাহী হানিফ, যাত্রীবাহী পিকআপ ও মালবাহী পিকআপের ত্রিমুখী সংঘর্ষে কমপক্ষে ৮ জন নিহত ও ১৫ জনের অধিক আহত হয়। ঐ দিন পিকআপ চালক দু’জনই ১৪ বছর তথা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় বেপরোয়া, দ্রুতগতিতে ওভারটেক করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনার শিকার হন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

এতে করে অকালে প্রাণ হারায় ২ জন শিক্ষার্থীসহ ৮ জন যাত্রী। কয়েকজন পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। গতকাল ২৭ মে ভোরে সড়কের বিওসি’র মোড় এলাকায় সিএনজি টেক্সী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা লেগে ১ মহিলাসহ ২ জন আহত হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনাজনিত কারণে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছে, আবার অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৭৫ কিলোমিটার এলাকার যাত্রীবাহী পিকআপ, সিএনজি টেক্সী চালকদের অধিকাংশই অপ্রাপ্ত বয়স্ক।

তাছাড়া এসব চালকদের মধ্যে অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগার উপর দিয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রকাশ্যে মহাসড়কে যাত্রীবাহী সিএনজি টেক্সী ও পিকআপ চালাচ্ছে শত শত লাইসেন্সবিহীন কিশোর চালক। পিকআপ ও সিএনজি টেক্সী চালানোর কাজে নিয়োজিত এসব কিশোরদের গাড়ী চালানোর ন্যূনতম জ্ঞান ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। সরকার চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি বাধ্যতামূলক করলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এসব সিএনজি চালক ও পিকআপ চালকেরা প্রথমে কয়েক মাস হেলপার হিসেবে কাজ করার পর কোন ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই বসে যাচ্ছে চালকের আসনে। ফলে যা ঘটার তাই ঘটছে।

প্রতিমাসে দুই-একটা বড়-ছোট দুর্ঘটনা ঘটছে এসব পিকআপ ও সিএনজি টেক্সীর প্রশিক্ষণবিহীন, অদক্ষ, কম শিক্ষিত কিশোর চালকদের কারণে। যে সকল কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিষেজ্ঞদের মতে তা হলো চালকেরা বেপরোয়া, অনিয়মতান্ত্রিক যানবাহন চালনা, মাত্রাতিরিক্ত গতি, ওভারলোডিং, যান্ত্রিক ত্রুটি, বিপজ্জনক সড়ক, পথচারীদের অসতর্কতা, চালকদের অনভিজ্ঞতা, ট্রাফিক অনুসরণ না করা, আইন বাস্তবায়নের অভাব, সড়কগুলোতে মিশ্র তথা বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহন চলাচল করা অন্যতম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ সকল বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন তৎপর নয়। ফলে যানমাল নিয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরা এখন বহুলাংশেই নিয়তির বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ছোট করতে ব্যর্থ হলে বর্তমান সরকারের এগিয়ে যাওয়ার এ গতি শ্রোত হয়ে পড়বে বলে তারা মত প্রকাশ করেন।
গত ১ আগস্ট’১৫ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে চার চাকার পিকআপগুলো বন্ধ ঘোষিত থ্রি-হুইলারের জায়গা দখল করে নেয়। এ থ্রি-হুইলার গুলো পিকআপের চেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন যাত্রীসাধারণ।

এক তথ্য সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৭৫ কিলোমিটার সড়কে পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া সড়কে সাড়ে চার শতাধিক যাত্রীবাহী পিকআপ চলাচল করছে। এসব পিকআপের মালিকেরা অপ্রাপ্ত বয়স্ক, প্রশিক্ষণবিহীন, লাইসেন্স ছাড়া চালকদের নিয়োগ দিচ্ছে কম পয়সা দিয়ে। লাইসেন্সধারী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকদের বেতন ৬শ থেকে ৭শ টাকার স্থলে এ সকল অনভিজ্ঞ, লাইসেন্সবিহীন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের দিচ্ছে ৩শ টাকা। আর এ সকল অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রশিক্ষণবিহীন চালকেরা গাড়ীর স্ট্যান্ডিং-এ বসে হয়ে যায় বেপরোয়া। গাড়ী চালাতে গিয়ে যাত্রীদের সাথে অশোভন আচরণের মত ঘটনাও ঘটছে। এ সড়কে প্রকাশ্যে দিবালোকে বেপরোয়া গতিতে যাত্রীবাহী সিএনজি অটোরিক্সা ও পিকআপগুলো চালালেও মহাসড়কে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ অজ্ঞাত কারণে নিরবতা পালন করছে। ফলে দিনের পর দিন অবৈধভাবে চালকের আসনে বসা কিশোরেরা হয়ে উঠছে বেপরোয়া। অপ্রাপ্ত বয়স্ক লাইসেন্সবিহীন গাড়ীর চালকের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এ ব্যাপারে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টি.আই) শাহ্ মো. আরিফুর রহমান যাত্রীবাহী পিকআপগুলোতে লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েছে বলে স্বীকার করেন। তাদের লোকবল কম থাকার পরও প্রতিদিন অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানান। প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। তারপরও সমস্যার উত্তরণ সম্ভব হচ্ছে না। স্পিডগান এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকার কারণে ওভার স্পিডের গাড়ীগুলোর বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান।

এ ব্যাপারে দোহাজারী হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেছেন, ডি.এল (ডাইভিং লাইসেন্স) প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে মামলা দিয়ে ৫শ টাকা জরিমানা করা যায়। সে জরিমানা দিয়ে পুনরায় গাড়ী চালায় ঐ চালক। তাছাড়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক এ সকল লাইসেন্সবিহীন চালকেরা অন্য কোন কারণে অপরাধী হলেও কিশোর হওয়ার কারণে শাস্তিও শিথিল হয়। ফলে লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে প্রতিমাসে বিভিন্ন স্পটে সচেতনতা সভা করে চলেছেন চালক-হেলপারদের নিয়ে। গতমাসে রওশনহাটে করা হয়েছে। মাইকিংও করা হচ্ছে। স্বল্প সময়ে চালক-হেলপারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তারপরও কমছে না এ সকল অবৈধ চালকের সংখ্যা। ফলে দুর্ঘটনা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ সকল অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকেরা প্রতিযোগিতা দিয়ে গাড়ী চালায়। দ্রুত, বেপরোয়াভাবে গাড়ী চালাতে গিয়ে ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
অভিযোগ ওঠেছে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মাহিন্দ্রা ও নাম্বারবিহীন সিএনজি টেক্সী সরকারি নির্দেশ অমান্য করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বেপোরোয়াভাবে চলাচল করছে। সে সাথে অপ্রাপ্ত বয়স্ক লাইসেন্সবিহীন চালকেরা চালাচ্ছে যাত্রীবাহী পিকআপ। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে বিজ্ঞ মহলের অভিযোগ। নাম্বারবিহীন যাত্রীবাহী পিকআপ, সিএনজি টেক্সী বেপরোয়াভাবে চলাচলের কারণে রোগীবাহী এ্যাম্বুলেন্সও যানজটের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শান্তিরহাট অটো সিএনজি সমবায় সমিতির নেতৃবৃন্দরা জানালেন, নাম্বারবিহীন সিএনজি টেক্সীগুলো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের শাহ আমানত ব্রীজ এলাকা থেকে পটিয়া পর্যন্ত যাওযার জন্য হাইওয়ে পুলিশকে মাসওয়ারা দিতে হয়। তাছাড়া মাহেন্দ্রা, সিএনজি টেক্সী, টেম্পু পটিয়া ও দোহাজারী যাওয়ার পথে হাইওয়ে পুলিশ, পটিয়া থানা ও পথিমধ্যে তিনদফা চাঁদা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন এসব গাড়ির চালকেরা। ফলে এ বাড়তি টাকাগুলো আদায়ের জন্য মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, যত্রতত্র পার্কিং ও রাস্তার দু’পাশে বালি-কংকীটের স্তুপের কারণে প্রতিদিনই যানজট লেগে রয়েছে শাহ্ আমানত সেতুর উত্তর পাড়ে (নগর এলাকা), মইজ্যার টেক, শান্তিরহাট, মুন্সেফ বাজার, থানার মোড়, পোস্ট অফিস এলাকা, ডাক বাংলোর মোড়, পটিয়া বাস স্টেশন, পটিয়া কলেজের পূর্ব গেইট, কমলমুন্সির হাট, দোহাজারী, কেরানীহাট, লোহাগাড়া সদরে। অন্যদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক মনসা বাদামতল, নিমতল দরগাহ্, গৈড়ালার টেক, নাইখাইনের টেক, কাগজী পাড়া মসজিদ ও কবরস্থান এলাকা, আমজুর হাট মোড়, কমলমুন্সির হাট মোড়, খরনা ব্রীজ, চা বাগান রাস্তার মাথা, বাগিচা হাট, বরগুনি পুল ছাড়াও পটিয়া শাহচাঁন্দ আউলিয়া মাজার গেইট এলাকায় রাস্তার দু’পাশে গাছের স্তুপের কারণে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। বান্দরবান, কক্সবাজার, চকরিয়া, আমিরাবাদ, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, দোহাজারী, পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় দুই লাখ লোক প্রতিদিন চট্টগ্রাম শহরে যাতায়ত করে থাকে। তাদের অভিযোগ, রাস্তায় যানজটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে যেতে পারছে না।

আরকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও সেক্রেটারি মোহাম্মদ মুছা জানিয়েছেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান সড়কে ছোট গাড়ি (মাহিন্দ্রা ও সিএনজি টেক্সী) কয়েকগুন বেড়েছে। এসব অধিকাংশ গাড়িতে রোড ফার্মিট ও রেজিস্ট্রেশন না থাকায় বাস মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের দাবির প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকও হয়। বৈঠকে এসব গাড়ি আরকান সড়কে যাতে চলতে না পারে তা সিদ্ধান্ত হলেও দীর্ঘদিনেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। মাহিন্দ্রা ও নাম্বারবিহীন সিএনজি টেক্সীর কারণে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস সময় মত পৌছতে পারছে না বলে তারা অভিযোগ করেছেন। এ ব্যাপারে তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.