নাম পরিবর্তন নোংরা রাজনীতির সংক্রামক ব্যাধি

0

এস এম মনসুর নাদিম-

প্রবাদ আছে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়েনা। কিন্তু এই প্রবাদ আমরা শুধু পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি এবং এটার অস্থিত্ব ও শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকে। এর বাইরে যেখানে চর্চা হওয়ার কথা অর্থাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে। সেখানে এই প্রবাদের কোন গুরুত্বও নেই। সরকার নড়ে গেল কিংবা পড়ে গেল তো সাথে সাথে গত সরকারের কর্মসুচীর চলন্ত ট্রেন থেমে গেল। সমস্ত লাল ফিতার ফাইল বন্ধ হয়ে গেল। উদ্বোধন হওয়া ভিত্তি প্রস্তরগুলির দ্বিতীয় দফে উদ্বোধন হয়। নাম ফলক মুছে নতুন নাম লিখা হয়। টেণ্ডার বাতিল করে রি-টেণ্ডার করা হয়।ক্ষমতা গ্রহনের উল্লাস যাত্রায় এটাই যেন মুল উদ্দেশ্য থাকে ।

বিশ্বের নানা দেশে দেশের বিখ্যাত ব্যাক্তিদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়ক সমুহের নামকরণ করা হয়।বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। বরং রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সহ কত বীর বীরাঙ্গনার নামে নামকরণ হবে এটাই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পর থেকে হয়েছেও তাই। কিন্তু ৭৫’ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সাথে সাথে ধীরে ধীরে পাকিস্তান মনস্কদের ক্ষমতার আশ-পাশে জমায়েত শুরু হওয়া এবং একসময় ক্ষমতার অংশীদার হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মিটাতে প্রতিশোধ স্পৃহার দাবানলে একের পর এক সুন্দর নামগুলি জ্বালিয়ে অত্যান্ত চাতুর্য্য পুর্ন ভাবে ইসলামী সুফি,দরবেশ ও আওলিয়াদের নাম সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে । নাম পরিবর্তনের নোংরা রাজনীতি কে বা কারা প্রথম শুরু করেছিল সেই বিতর্কে আমি যাবনা।

তবে এটা’যে রাজনীতির নোংরা পদ্ধতি এবং প্রতিহিংসা পরায়ন মূলক তা সকল সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই অনুধাবন করতে সক্ষম। এই কথা পরিস্কার, যারাই এই নোংরা রাজনীতি করেছে ও করবে তারাই জনগণের নিকট বারবার প্রত্যাখ্যাত হবে। এই কথা জেনে রাখা দরকার রাজনীতিতে তারা ইসলামকে ব্যাবহার করেছে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায়ের সহানুভূতি লাভের আশায় এবং পরবর্তীতে কেউ ইচ্ছা করলেও ধর্মীয় সংখ্যা গরিষ্টের রোষানলের ভয়ে তা পরিবর্তন করতে পারবেনা এই অসুস্থ চিন্তা মাথায় রেখে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় থাকার একটা পাকা বন্দোবস্ত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ব্যাক্তি বিদ্বেষ,পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসার মুলে কিন্তু পাকিস্তান পন্থিদের পরাজয়ের গ্লানি। এই গ্লানি ধীরে ধীরে ক্ষোভে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে জিঘাংসার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-‘দেখতে নারি যারে তার চলন বাঁকা’।

বর্তমানের বিরোধীদলের রাজনীতির আচরণই হল এটা। ভাল-মন্দ বিচার বিবেচনা করার দুঃসাহস কোন নেতা করেননা। দলীয় প্রধান যাই বলবেন, বাকিদের মুখেও একই ‘রা’। মেধা শূন্য রাজনীতিতে শুধু মাত্র বিরোধিতার জন্যই যেন বিরোধিতা করা হয়। যৌক্তিক কোন আলোচনা কেউ করেনা। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দাবীতে রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনার দাবী ছিল বিএনপি’র। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করে দিলে সেই সার্চ কমিটিই রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া নাম থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেন। এতেও নানা সন্দেহ, নানা গলদ। একসময় বিএনপি প্রধানই বলেছিলেন-‘পাগল ও শিশু ব্যাতীত কেউ নিরপেক্ষ নয়’।

যদি তাই হয় তাহলে তিনি একেবারে পিউর নিরপেক্ষ লোক পাবেন কোথায় ? দুর্মুখেরা বলে, শুধুমাত্র রাজাকার দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে তখন হয়তো বিএনপি মেনে নিতে পারে। কেউ কেউ বিগত সময়ের প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের প্রসঙ্গ টেনে এনে জল ঘোলা করতে চেষ্টা করছেন। কে এম হাসানের কথা আর নুরুল হুদা সাহেবের কথা একনা। কে এম হাসানকে বিএনপিই বিতর্কিত করেছিল ১৯ জন বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে। কে এম হাসান একজন বুদ্ধিমান ভদ্রলোক। তাই তিনি নিজেই সরে গিয়েছিলেন।

এখন নুরুল হুদা সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি জনতার মঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জনতার মঞ্চ ও এর প্রেক্ষাপট বর্ননা করতে গেলে মূল বিষয় থেকে আমাকে সরে যেতে হবে এবং স্থান সংকুলান এর ও একটা ব্যাপার আছে। তাই আমি ওদিকে যাচ্ছিনা, কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাক্তি মাত্রেই জনতার মঞ্চ সম্বন্ধে ধারনা রাখেন। তাই জনতার মঞ্চের সাথে কারো সম্পৃক্ততা তার নিরপেক্ষতা হারানোর দলিল নয়। যাদের এরকম চিন্তা চেতনা থাকে তাদের অন্তত উচিৎ ছিলনা নিরপেক্ষ লোক খোঁজার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট যাওয়া।

আমি আমার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। নাম বদলের নোংরা রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার সংস্কৃতির কথা বলছিলাম। কিছুদিন আগে বিএনপি’র শামসুজ্জামান দুদু এক সভায় বলেছিলেন-বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ঢাকা সিটি’র নাম পরিবর্তন করে জিয়া সিটি রাখা হবে। এটা কী সুস্থ রাজনীতির পরিচয় ? দুদু’র মত একজন সাবেক ছাত্র নেতা কী করে এমন কথা বলতে পারলেন ? এই জন্য কী দুদু সাহেবকে ওপরে জবাবদিহি করতে হয়েছে ? হয়নি। আওয়ামীলীগেও হয়না।

তাহলে কীভাবে সুস্থ রাজনীতির ধারায় ফেরা যাবে ? যে কোনও দলের কিংবা সংগঠনের একজন মাত্র মুখপাত্র থাকা চাই। যিনি সব বিষয়ে ব্রিফিং দেবেন। কোনও সভায়ও মেপে কথা বলবেন। অথচ বড় দুই দলে যখন যিনি মাইক্রোফোন পাচ্ছেন তিনিই ইচ্ছেমত বলছেন। এতে দলের কিংবা দলীয় প্রধানের ভাবমুর্তির কী হচ্ছে বা হবে তা চিন্তা করার মত ফুরসৎ যেন নেই।

মোগল আমলে ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীর নগর। পরবর্তীতে ঢাকা। এবার দুদু সাহেব ঘোষনা দিলেন ‘জিয়া সিটি’ করবেন। নাম পরিবর্তনে কী সুখ সেটা জানিনা। তবে এটা বুঝতে পারি নাম পরিবর্তন একটা নোংরা রাজনীতির সংক্রামক ব্যাধি। যেই ব্যাধি থেকে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি কেউই বেরিয়ে আসতে পারছেনা। মজার ব্যাপার হল, জামায়াত বিএনপি’র আমলে আওয়ামীলীগের দেয়া যে নামগুলি পরিবর্তন করা হয়েছিল, তা বেশিরভাগই স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তি যোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্যাগি নেতাদের নামের স্থাপনা। মওদুদী বাদীরা মাজার সংস্কৃতি ও আল্লাহর অলিদের মানেনা।

কিন্তু যখন নাম পরিবর্তনের পালা এলো তখন অত্যান্ত চাতুর্য্যতার আশ্রয় নিয়ে তারা আল্লাহর অলিদের নাম ব্যাবহার করলো। এই জন্যই বোধহয় বলে-‘শয়তান যদি কখনো কোন ভালো কাজ করে, তখন মনে করতে হবে ওখানেও তার শয়তানি উদ্দেশ্য লুকিয়ে রয়েছে’। সুতরাং তারা আল্লাহর অলিকে ভালবেসে তাদের নাম মোবারক ব্যাবহার করেনি। তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এটা করেছে যা দিনের আলোর মত পরিস্কার। আজ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। জামায়াত আগেই জানতো এরকম কিছু একটা হবে। তাই তারা ক্ষমতায় থাকা কালে বড় বড় চেয়ার গুলিতে জামায়াতী ছদ্মবেশীদের বসিয়ে এখনো দক্ষতার সাথে খেলে যাচ্ছে।

বিএনপি দলটাকে তো গ্রাস করেছেই অধিকন্তু আওয়ামীলীগে, ছাত্রলীগে, যুবলীগে ও নানা ধরনের নব্য লীগের সংগঠন গুলিতে তারা আওয়ামীলীগের জার্সি পরে খেলছে। লীগের কর্মীরা অসহায়। প্রবীন নেতারা বিষয়টা বুঝতে পারলেও কিংকর্তব্য বিমুঢ !স্বাধীনের পর পর কিছু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় প্রবেশ করলেও এখন তা বেরিয়ে আসছে। স্থানীয়রা জানতেন, কে মুক্তিযোদ্ধা কে রাজাকার। তাই তারা এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শুক্রুবারের মুক্তিবাহিনী (চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় শুক্কুর বাইজ্জ্যে মুক্তিবাহিনী)বলতেন।

সেই থেকে এখনো থেমে নেই স্বাধীনতা বিরোধীরা। নানা ছলে-বলে তারাই স্বাধীনতার হর্তা-কর্তা বনতে আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ইতিহাস বিকৃতি করে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুবিধাবাদীদের সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কারন গানের ভাষায় বলতে গেলে-‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়…’। তাই এটা কিংবা এটার কৃতিত্ত্ব কেউ কোনোদিন ছিনিয়ে নিতে পারবেনা।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.