পাহাড়- হ্রদ-ঝরণার মিলন রাঙামাটি

0

মো: সাইফুল উদ্দীন, রাঙামাটি :  ছবির মতো সবুজে ঘেরা পাহাড় আর কাপ্তাই হ্রদের বিশাল স্থির নীল পানি রাশি রাঙামাটিকে বাংলার সৌন্দয্যের স্বর্গে পরিণত করেছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের অপার আঁধার পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। তাই পার্বত্য শহর রাঙামাটি পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম। ঈদে ছুটিতে রাঙামাটিতে পর্যটকদের ঢল নামে। এখানে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকে শান্ত জলের হ্রদ। সীমানার ওপাড়ে নীল আকাশ মিতালি করে হ্রদের সাথে, চুমু খায় পাহাড়ের বুকে। এখানে চলে পাহাড় নদী আর হ্রদের এক অপূর্ব মিলনমেলা। তাই এবারের ছুটিতে নাগরিক যন্ত্রণা থেকে কিছুটা প্রশান্তি পেতে ঘুরে আসুন পাহাড়, হ্রদ ও ঝরণার দেশ রাঙামাটি।

রাঙামাটির দর্শনীয় স্থান :
রাঙামাটিতে ভ্রমণ করার জন্য রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে কাপ্তাই হ্রদ, পর্যটন মোটেল, ডিসি বাংলো, ঝুলন্ত ব্রিজ, সাজেক, পেদা টিংটিং, সুবলং ঝর্ণা, রাজবাড়ি, রাজবন বিহার, উপজাতীয় জাদুঘর, কাপ্তাই হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সাজেক : সাজেক পাহাড়ের সঙ্গে নীল আকাশের গভীর মিতালী। ছন্নছাড়া মেঘগুলো যেন উড়ে এসে বসেছে পাহাড়ের কোলে। সকাল-সন্ধ্যা প্রায় সময়ই পাহাড়ে মেঘের খেলা সাজেকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। যেদিকে চোখ যাবে, শুধু মেঘ আর রংয়ের খেলা। সর্বোচ্চ চূড়া থেকে নিচে দূরের গ্রামের দিকে তাকালে মনে হবে পটে আঁকা আধুনিক কোনো ছোট্ট শহর!
সা¤প্রতিক সময়ে কল্পনাতীত পরিবর্তন ঘটেছে সাজেকের। নতুন অনেক কিছুই যোগ হয়েছে সেখানে। বিদ্যুৎ নেই ঠিকই; আছে সোডিয়াম লাইট, বায়ো-বিদ্যুৎ। মসৃণ সড়ক, থ্রি স্টার মানের হোটেল, রিসোর্ট, কাবও গড়ে উঠেছে। আর সে কারণেই প্রাকৃতিক নিসর্গে সাজানো সাজেক এখন পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। পর্যটনবান্ধব সাজেক প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এক সময়ের দুর্গম সাজেকে এখন রাতের চিত্রও ভিন্ন। রুইলুইপাড়াতে রাতে জ্বলছে সোডিয়াম বাতি, তাও আবার স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে তাকালেই মনে হবে, মেঘের চাদর ঢেখে রেখেছে সাজেককে।

সাজেকে যেতে হলে খাগড়াছড়ি জেলার ওপর যেতে হবে। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা যাওয়ার পর সেখান থেকে মোটর সাইকেল কিংবা চাঁদের গাড়িতে সাজেক যাওয়া যাবে।পাহাড়- হ্রদ-ঝরণার মিলন রাঙামাটি

কাপ্তাই হ্রদ: পাহাড়ি এই জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমণ অন্যতম। ষাটের দশকে কর্ণফুলীর খর¯্রােতা পানিতে বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে দেশের সবচে বিশাল কৃত্রিম হ্রদ। মূলত পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই বাঁধ নির্মিত হয়। অসংখ্য পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা বিশাল কাপ্তাই হ্রদে নৌবিহারে অনুভূতি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। দেশীয় ইঞ্জিন নৌকা, লঞ্চ, স্পিডবোটে দিনভর নৌবিহার করা যেতে পারে। যে দিকে চোখ যায়, কেবল পানি আর তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট টিলা। লালমাটির টিলাগুলোর গাঁয়ে সবুজের সমারোহ, যেন এগুলো ঢেকে আছে সবুজ কার্পেটে। কখনো ডানে, কখনো বামে আবার কখনো বা মনে হবে সম্মুখে সীমাহীন পথ।সারাদিন কাপ্তাই হ্রদে ভ্রমণের জন্য একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভাড়া পড়বে ১৫০০-২৫০০ টাকা। সাথে লাইফ জ্যাকেটটা নিতে ভুলবেন না।
রাঙামাটি মোটেল ও ঝুলন্ত সেতু: রাঙামাটি শহরের শেষ প্রান্তে হ্রদের ওপর গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন মোটেল পার হলেই ঝুলন্ত সেতু। ঝুলন্ত সেতুতে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে দৃশ্যমান লেকের অবারিত জলরাশি ও দূরের উঁচু-নিচু পাহাড়ের আকাশছোঁয়া বৃরাজি। এখানে রয়েছে কটেজ, পার্ক, পিকনিট স্পট, স্পিড বোট ও সাম্পানের মতো দেখতে নৌযান।

রাজবন বিহার: পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় তীর্থস্থান রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী রাজবন বিহার। চাকমারা অবশ্য বিহার বা মন্দিরকে কিয়াং বলে থাকে। এটি বাংলাদেশের একটি প্রধান বৌদ্ধবিহার। ৩৩ দশমিক ৫ একর এলাকায় ৪টি মন্দির, ভিুদের ভাবনা কেন্দ্র, বেইনঘর, তাবতিংশ স্বর্গ, বিশ্রামাগার ও হাসপাতাল রয়েছে এতে।
সুবলং জলপ্রপাত: পাহাড়ি ঝরণার শীতল জলধারার আকর্ষণ বোধ করে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণি। সুবলং ঝরণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব নৈসর্গিক সৃষ্টি। এটি রাঙামাটির বরকল উপজেলায় অব¯ি’ত। সুবলং ঝরণা ৩০০ ফুট উঁচু। বর্ষাকালে জলধারার অবিরাম পতনে সৃষ্ট ধ্বনি সবাইকে কাছে টানে।
টুক টুক ইকো ভিলেজ : হ্রদে দীর্ঘ ভ্রমণে কান্ত-পরিশ্রান্ত অতিথির জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি রেস্তোরাঁয় রকমারি খাবারের স্বাদ। কাঠ এবং বাঁশের কারুকাজে তৈরি এ রেস্তোরাঁয় দেশিয় ও পাহাড়ি মজাদার সব খাবার-দাবার পাওয়া যাবে। ৫০ একর জায়গা জুড়ে বহু টিলা-উপটিলায় পুরো ইকো ভিলেজটিতে সুদৃশ্য বেশ কয়েকটি কাঠের কটেজ। জানালার ফাঁক গলিয়ে দূরে পাহাড়ের ঢালে কাপ্তাইয়ের পানিতে চাঁদের প্রতিচ্ছবি অসাধারণ। রাতগভীরে বন-বনানী থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকা, নাম জানা-অজানা নিশাচর পশু-পাখির বিচিত্র ডাকে অজানা রাজ্য এসে সামনে দাঁড়ায়। আছে সার্বণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।  রাঙামাটি
বালুখালী : রাঙামাটি শহরের কাছেই বালুখালী কৃষি খামার। খামারের বিশাল এলাকা জুড়ে যে উদ্যান রয়েছে, তা এককথায় চমৎকার। এখানে প্রায় সময় দল বেঁধে লোকজন পিকনিক করতে আসে। খামারটিতে ফল-ফুলসহ অসংখ্য প্রজাতির গাছগাছালি রয়েছে। রাঙামাটি শহর থেকে স্পিডবোট ভাড়া করে এখানে আসা যায়। ভাড়া দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা। তবে দেশীয় ইঞ্জিন বোটে ভাড়া ৮’শ থেকে হাজার টাকা।

ডিসি বাংলো : রাঙামাটি শহরের জিরো পয়েন্টে কর্ণফুলী হ্রদের গা ঘেঁষে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলো। সংযোগ সড়ক ছাড়া বাংলোর তিনদিকেই ঘিরে রেখেছে হ্রদের বিস্তীর্ণ জলরাশি। বাংলোর পাশে ছোট টিলার উপরে রয়েছে একটি বাতিঘর ও কোচপানা নামক ছাউনী, যা সেতু দ্বারা বাংলোর সাথে সংযুক্ত। সেতু এবং ছাউনী থেকে পর্যটক ও দর্শনার্থীগণ অকাতরে হ্রদের রূপ-সুধা অবগাহণ করতে পারে। রাঙামাটি শহরের যে কোন স্থান হতে অটোরিক্সাতেও এখানে আসা যায়। তবে বাংলো এলাকায় প্রবেশের জন্য অনুমতি আবশ্যক।

উপজাতীয় যাদুঘর : রাঙামাটির প্রবেশ দ্বারেই দৃষ্টি কাড়ে উপজাতীয় যাদুঘর। ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু এটির। ২০০৩ সালে নতুন ভবন নির্মিত হলে তা আরো সমৃদ্ধ হয়। এ যাদুঘরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিসত্তাসমূহের ঐতিহ্যবাহী অলংকার, পোষাক-পরিচ্ছদ, বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহার্য তৈজষপত্র, অস্ত্র-শস্ত্র, প্রাচীন মুদ্রা, প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থ, পুঁতিপত্র, তৈলচিত্র ও উপজাতীয় জীবনধারার বিভিন্ন আলোকচিত্র রয়েছে।
যেভাবে রাঙামাটিতে আসবেন : ঢাকা থেকে ইচ্ছে করলে সরাসরি রাঙামাটি আসতে পারেন। অথবা চট্টগ্রাম হয়েও আসা যায়। চট্টগ্রাম থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে রাঙামাটি প্রায় সাড়ে ৩শ কিলোমিটার। ঢাকার কমলাপুর থেকে এস আলম, শ্যামলী ও ইউনিকসহ বিভিন্ন পরিবহনে যাওয়া যায়। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন থেকে এক ঘণ্টা পরপর পাহাড়িকা বাস এবং প্রতি আধা ঘণ্টা পর বিরতিহীন বাস ছেড়ে যায় রাঙামাটির উদ্দেশে। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১০০ থেকে ১৩০ টাকা। নগর থেকে রাঙামাটি যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.