বানীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষে তারুন্যের উল্লাস

0

গোলাম শরীফ টিটু : চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় প্রথম প্রতিষ্টিত মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্টান বানীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উৎসব গত ১৬-১৮ মার্চ (তিন দিন ব্যাপী) বর্নাট্য অনুষ্টানমালার মাধ্যমে পালিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার(১৬মার্চ) বিকাল ৪টায় প্রতিষ্টাতা পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও ভুমিদানকারী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন বয়োজেষ্ট্য সদস্য সুজিত কুমার রায়।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় প্রধান অতিথি স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা পিপিএম, জেলা পরিষদ সচিব শাব্বির ইকবাল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী মো: চাহেল দস্তুরী ও প্রথম আলোর যুগ্ন সম্পাদক কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

২য় দিন ১৭ মার্চ শুক্রবার সকাল ১০টায় বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সমন্বয়ে বিশাল আনন্দ র‌্যালী উদ্বোধন করেন কুয়েত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত এস.এম আবুল কালাম। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহনে এই আনন্দর‌্যালীটি বানীগ্রামস্থ স্কুল গেইট থেকে শুরু হয়ে ইউনিয়নের গুরুত্বপুর্ন সড়ক প্রদক্ষিন করে। র‌্যালির সমন্বয়কারী ছিলেন শতবর্ষ উৎযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও সাবেক ছাত্রনেতা দেলোয়ার হোসেন। প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাচ ভিত্ত্বিক আলাদা সাজ সজ্জা ও বাদ্যবাজনা আনন্দ র‌্যালীকে করেছে প্রানবন্ত।

প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী

দুপুর বারোটার দিকে র‌্যালিটি স্কুল গেটে এসে শেষ হয়। মধ্যাহ্ন ভোজের পর বিকাল ৩টায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পানি সম্পদক মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, বিশেষ অতিথি ইউএসটি’র উপাচার্য প্রফেসর ডা. প্রভাত বন্দ্র বড়ুয়া, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম ও বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম মনোজ সেনগুপ্ত। সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে জমকালো সাংস্কৃতিক অসুষ্টান। এতে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও খ্যাতিমান শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তারুন্যের ব্যান্ড দল ’নাটাই’ আসে ভীন্নধাছের কিছু গান নিয়ে। বিদ্যালয়ের মাঠের অর্ধেক অংশব্যাপী স্থাপিত শতবর্ষ প্যান্ডলকে ঘিরে ছিল হাজারও ছাত্র-ছাত্রী ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি। পুরনো সহপাঠীদের নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডায় ব্যস্ত থাকে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। অনেকের বিভিন্নভাবে উল্লাস প্রকাশ ছিল দেখার মত।

কেউ আরা আবেকাপ্লুত হয়ে হয়ে যান। প্রতিটি ব্যাচ-এর ছাত্র ছাত্রীদের আলাদা কিছু অনুষ্টানও ছিল অনুষ্টানের জন্য ভীন্নমাত্রা। যেমন-নাচ, গান, আবৃতি ও স্মৃতিচারন। ১৯৯২ ব্যাচের সমন্বয়কারী ও বিদ্যালয়ের দাতা পরিবারের সন্তান শান্তনু রায় সুজন বলেন,’৯২ ব্যাচ এর ছাত্র-ছাত্রীদের স্মৃতিচারন, মেরাথন, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, ক্রেস্ট বিতরন ও কুপন প্রতিযোগিতার মত আয়োজন করেছে। একই ভাবে প্রতিটি ব্যাচ এর রয়েছে আকর্ষনীয় সব অনুষ্টানমালা। সমাপনির দিন ১৮ মার্চ পুরস্কার বিতরনী সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন, বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারন সম্পাদক সুকান্ত ভট্টাচার্য্য। দুপুর ১২টায় শিক্ষা ও প্রতিযোগিতামুলক বিশ্ব সেমিনারে বক্তা ছিলেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন।

বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সমন্বয়ে বিশাল আনন্দ র‌্যালী

বিকাল ৩ টায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি শিক্ষা সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীন এমপি, বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, ফিরোজপুর জেলা জজ আদালত এর বিচারক মুহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান ও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ার। শেষ দিন ছিল আরও উৎসবমুখর। জানা গেছে, শর্তবর্ষ উৎযাপন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মহাুম্মদ নাদেরুজ্জামান চৌধুরী ও সদস্য সচিব লে. কর্ণেল তপন মিত্র চৌধুরী (অব.) এবং প্রধান সমন্বয়কারী সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাকিমুল হায়দার চৌধুরী। অনুষ্টানে যোগ দিতে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী নিবন্ধন করেছিলেন।

উপজেলার বানীগ্রামের সবুজ পাহাড়ের উপর ছয় একর এলাকাজুড়ে অবস্থিত বানীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়। শতবর্ষী এই বিদ্যাপীঠের পেছনে রয়েছে অনেক শিক্ষানুরাগীর অবদান। একশ বছর ধরে এ বিদ্যালয়টি অনেক কীর্তিমান শিক্ষার্থীর জন্ম দিয়েছে। অবদান রেখেছে এলাকার শিক্ষা বিস্তার, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও ক্রীড়াজগতে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বানীগ্রামের সম্ভ্রান্ত রায় পরিবারের তিন ভাই গিরিন্দ্র চন্দ্র রায়, সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় ও নগেন্দ্র কুমার রায় ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারী এই বিদ্যালয় প্রতিষ্টা করেন। শুরুতে যোগেন্দ্র চন্দ্র দাস ও কালী কুমার আচার্য শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

ওই সময় ছাত্র ছিল মাত্র ৭ জন। ১৯২০ সালে দশম শ্রেনী খোলার পর এটি পুর্নাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপ নেয়। ১৯১৯ সালে বিদ্যালয়টি বাঁশখালীর প্রথম মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি লাভ করে। ১৯২১ সালে বিদ্যালয় থেকে প্রথমবারের মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সাতজন অংশ নেন। বাঁশখালীর প্রধান সড়কের পাশে শহীদ মিনার থেকে মাত্র একশ মিটার পুর্বে পাহাড়ের চুড়ায় প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে বিদ্যালয়টির অবস্থান। রয়েছে ছোট বড় ছয়টি ভবন, কম্পিউটার ল্যাব, দুটি বিজ্ঞানাগার, দুটি ছাত্রাবাস, মসজিদ, মিলনায়তন ও খেলার মাঠ। বিদ্যালয়ের ৪২জন ছাত্র ১৯৭১ সালের জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা ছিল এ বিদ্যালয়।

১৯৫২সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের খবর পেয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারী বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতীকী ধর্মঘট করেন। বাঁশখালীর শীর্ষস্থানীয় এ বিদ্যালয়টি অনেকের দানে ধন্য হয়েছে। খেলার মাঠের জন্য বিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্মপরিষদ সদস্য ক্ষিরোদ রঞ্জন দাশের অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯৩৩ সালে তৎকালীন ভারতীয় বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য বৈলছড়ি নিবাসী খান বাহাদুর বদি আহম্মদ চৌধুরী জমি কিনে মাঠের জন্য দান করেন। পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান নিবাসী খান বাহাদুর আব্দুল মমিনও বিদ্যালয়ের জন্য জায়গা দান করেন। ১৯৩৬ সালে এই বিদ্যালয় প্রথম সরকারী সহযোগিতা পায়। ১৯৬২ সালে গৌবিন্দ প্রসন্ন চৌধুরী ডাক বিভাগের চাকরির অবসরের পুরো টাকা বিদ্যালয়ে দান করেন।

দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিক্ষাব্যবস্থায় শীর্ষস্থানীয় এ প্রাচীন বিদ্যাপীঠকে বছরের পর বছর শ্রম ও অর্ধ দিয়ে যারা একশত বছর পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমদ আনোয়ার, আওয়ামী লীগ নেতা জাকেরুল হক চৌধুরী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি সিকদার, সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা এম. হাবিব উল্লাহ চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক এমপি মোকতার আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার মো: ছমিউদ্দিন। বর্তমান সভাপতি খোন্দকার মো: সালাউদ্দিন কামাল।

যার নিরলস প্রচেষ্টায় উদযাপন হয়েছে শতবর্ষের বর্নাট্য অনুষ্টানমালা। এ কমিটিতে আরও আছেন সদস্য সচিব ও প্রধান শিক্ষক হৃষিকেশ ভট্টাচার্য্য, অভিভাবক সদস্য আবুল কালাম আজাদ, কামাল উদ্দিন আহমদ, সাবেক ইউপি সদস্য এম. ফেরদৌস উল হক, সুশীল দে (টুটু), লাকী ভারতী, শিক্ষানুরাগী সদস্য এয়ার মোহাম্মদ, শিক্ষক প্রতিনিধি নেপাল কান্তি দাশ, মো: নুরুল কাদের ও জিনাত রেহেনা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.