ভাগ্যে নয়,ব্যবসা চলে বুদ্ধিতে

0

এস এম মনসুর নাদিম :: অধিকাংশ ব্যবসায়ীর ধারনা ব্যাবসা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমি বলি ব্যবসা বুদ্ধির ব্যাপার।বুদ্ধি না থাকলে শুধুমাত্র কথিত ভাগ্য নিয়ে ব্যবসা চলেনা। যাদের বুদ্ধি বেশি তারাই সফল ব্যবসায়ী। তাহলে আসুন একেবারে ছোট্ট ব্যবসা থেকে আরম্ভ করি। আপনি একজন ছোট্ট দোকানদার। সেটা হোক ইলেক্ট্রনিক্স, হোক কাপড়ের দোকান কিংবা কসমেটিক্স অথবা সবজি কিংবা পানের দোকান। পাশাপাশি আরও দুটো সেইম দোকান আছে। আপনার দোকানের তুলনায় ওইসব দোকানে ব্যবসাপাতি ভালো। গ্রাহকের ভিড়ও প্রচুর।

অথচ আপনার দোকানে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও গ্রাহকের ভিড় নেই।আপনি ভেবে বসলেন, আপনার ব্যবসা ভাগ্য ওদের তুলনায় কম। দোকানে ব্যবসাপাতি বৃদ্ধির লক্ষে আপনি কোন হুজুরের নিকট থেকে তাবিজ নিয়ে পিঠের দেয়ালের সাথে সেঁটে দিলেন। জমজমের পানি,মাজারের পানি, হুজুরের পড়া পানি সকাল-বিকাল দোকানে ছিটাতে লাগলেন কোন পরিবর্তন নেই। লোকসানে লোকসানে ব্যবসা লাটে ওঠার যোগাড়। আপনার দুশ্চিন্তা আর মন খারাপে ব্যবসায়ে আরও অমনোযোগী হয়ে ব্যবসার আরও ক্ষতি বাড়িয়ে দিয়ে লাভ কী ?

তারচেয়ে বরং একটু ভাবুন, সবকিছু থাকা সত্বেও আপনার দোকানে গ্রাহক আসেনা কেন ? একটা ছোট্ট গল্প বলি, এক সেলুন ওয়ালারও আপনার মত অবস্থা হয়েছিল। নরসুন্দর বেশিরভাগ সময় গালে হাত দিয়ে বসে থাকত।আশপাশের সেলুন থেকে যখন কচাৎ কচাৎ ক্ষুর-কাঁচির অনবরত শব্দ আসতো, মনে হত যেন তার কলিজার ওপরই এই ক্ষুর-কাঁচি চলছে আর ভেতরে রক্ত ক্ষরন হচ্ছে। নরসুন্দরদের নাকি সাত চোঙ্গা বুদ্ধি। তাই এই নরসুন্দরও ভাবতে লাগলো কী করে দোকানে গ্রাহকের ভিড় লাগানো যায়। অন্য দোকানগুলিও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করলো।

একদিন তার মাথায় এলো কিছু বুদ্ধি। সেটা সে কাজে লাগালো। দোকানে কিছুটা নতুন ভাবে ডেকোরেশন করলো। এ্যাপ্রন গুলোর কালার চেঞ্জ করলো। প্রতিদিন আইরন করা এ্যপ্রন এবং চাদর ব্যবহার করতে শুরু করলো। বহুল প্রচলিত দৈনিক পত্রিকাটা রাখা শুরু করলো। দরজার হাতল টা আগের চেয়ে আরও খানিকটা নীচে স্থাপন করলো যেন অনায়াসে কোন শিশুর হাতে দরজার হ্যাণ্ডেলটা পৌঁছে। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন যেটা করলো, তাহল-তার গোমড়া মুখে সারাক্ষনই হাসি লাগিয়ে রেখেছে।

সে বুঝে গেছে মানুষের চেহেরা কদর্য হলেও তাতে যদি খানিকটা হাসির রেশ সবসময় লেগে থাকে মানুষকে কী অপুর্ব সুন্দর লাগে। যারা বুদ্ধিমান তারা জানেন হাসি একটি শক্তিশালী অস্ত্র। যা বড় বড় বিপদের পাহাড়কে চুর্ন করে দেয়ার মত শক্তি রাখে। নরসুন্দরের সামান্য বুদ্ধিতে অচল সেলুনে গ্রাহকের ভিড় বেড়ে গেলো।

তাহলে কী, বুদ্ধিতে অচল ব্যবসা সচল হল কিনা ? নরসুন্দর যদি ভাগ্যের ওপর ভরসা করে সকাল-বিকাল দোকানে গঙ্গাজল ছিটাত আর ধুপ-ধুনা দিয়ে দেবীর পুজা করতো ব্যবসার অবস্থার পরিবর্তন হতো ? জমজমের পানি, তাবিজ, গঙ্গাজল ও দেবীর পুজার ব্যপারে আমার বক্তব্যকে ভুল বোঝার কোন অবকাশ নেই। এগুলো ধর্মীয় আবেগ এবং পবিত্রতার জন্য মানুষ করে থাকে। তা দোষের কিছুনা। আমার বক্তব্য অন্যখানে। ভুল চিহ্নিত না করে এবং সংশোধন না করে শুধু ধর্মীয় আবেগ দিয়ে কিছু হবেনা।

এখন আসুন আপনার ছোট্ট দোকান প্রসঙ্গে। আপনি যদি আপনার ব্যবসার মন্দাভাব কিংবা ত্রুটি কোথায় তা চিহ্নিত করতে না পারেন তাহলে তা সংশোধন করবেন কেমন করে ?রোগের লক্ষন না বুঝলে, রোগ কীভাবে নির্নয় করবেন ? আর রোগ যদি নির্নয় করতে না পারেন ওষুধ দেবেন কীভাবে ?প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে আপনাকে সারাক্ষনই আপনার প্রতিযোগীর প্রতি নজর রাখতে হবে। প্রতিযোগীর দোকানের ডেকোরেশন, তার ডিসপ্লে তার পোশাক, তার আচরণ সবকিছু খুঁটে খুঁটে আপনাকে দেখতে হবে।শিখতে হবে।

ভাবতে হবে কীভাবে ওর চেয়ে আপনি Better করবেন। ব্যবসায়ে একটা কথা আছে- Customer Alwas Right. গালি দিলেও দোকানদার কাস্টমারের সাথে রাগ করতে পারেননা।আপনার মাঝে ঐ অভ্যাসটা না থাকলে তা গড়ে নিতে হবে। কথায় বলে- ব্যবসা ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষদের সম্পদ। হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে-আওরাত শরম, দোকানদার নরম মাস্টার গরম’। নারীর লজ্জা থাকা, ব্যবসায়ীর মেজাজ ঠাণ্ডা থাকা ও শিক্ষকের রাগ থাকা উচিৎ। এই তিন শ্রেনীর মাঝে উল্লেখিত গুণ থাকা মানেই হল সফলতা।

সফলতার কোন লাল সবুজ রঙ নেই। সফলতা আপনার অবয়বের অভিব্যক্তি। আসলে ঘুরে-ফিরে কথা একটাই আসে, আমরা মানুষেরা সবাই অভিনেতা। যে যার অবস্থান থেকে অভিনয় করে যাচ্ছেন। যিনি পেশাগত কারনে যতবেশি দক্ষ অভিনেতা তিনি ততো বেশি সফল। একজন উত্তম বিক্রয়কর্মীকে দক্ষ অভিনেতা হতে হয়। প্রতিদিন সে তার উত্তম পারফরম্যান্স দ্বারা দোকানের বিক্রি বৃদ্ধি করে থাকে।অনেকে প্রশ্ন করেন- বিক্রয়কর্মীকে কি রকম হওয়া দরকার। আমার সজা-সাফটা জবাব হল, একজন বিক্রয়কর্মীকে কথা-বার্তা ও পোশাকে অবশ্যই স্মার্ট হতে হবে।

কথার মাধ্যমে গ্রাহককে আকৃষ্ট করার মত বৈশিষ্ট ও দ্রুত কাজ করার মত দক্ষতা আয়ত্ব করতে হবে। দীর্ঘ সাতাশ বছর প্রবাসজীবনে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দেখেছি বাঙালিদের ব্যাবসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাঙালি কমিউনিটিতে সীমাবদ্ধ। কারণ তারা ব্যাবসায়র বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষিত না। কাস্টমারের প্রতি অবহেলা, কথা-বার্তায় আন স্মার্ট ও যথাযথ ড্রেস আপে অমনোযোগী। ভারতীয়রা কথায় কথায় বলে থাকে-‘কাস্টমার ভগবান কা রূপ হোতা হ্যাঁয়’। আর কিছু বাঙালি ব্যাবসায়ীকে দেখেছি তারা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কাস্টমারদের বলে- নিলে নেন, না নিলে যান। ছোট ছোট বাংলাদেশী খাবারের দোকান গুলোর কথা ধরা যাক। পাশের দোকানের কেউ যদি ফোনে বলেন- ভাই দুটো চা পাঠিয়ে দেন গেস্ট এসেছে।

ওদিক থেকে জবাব আসে লোক নেই এসে নিয়ে যান।আমার বুঝে আসেনা এরা এত পুঁজি খাঁটিয়ে কেন ব্যাবসা করেন এখানে ? কাস্টমার টেকাই পড়েনাই। টেকাই পড়েছেন আপনি। যে পুঁজি খাঁটিয়ে বিদেশে বসে আছেন ব্যাবসায়ের আশায়। আমি দেখেছি কোন ভারতীয় দোকানীকে কেউ ফোন করলে এক কিলোমিটার দুর থেকে টিং টিং করে সাইকেলে চা নিয়ে আসতে । সাথে থাকে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি যা দেখে কাস্টমারের মন ভালো হয়ে যায়। দশ তলায় চড়ে কাস্টমারকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কিংবা পাতার বিড়ির বান্ডেল দিয়ে আসতে দেখেছি।

আমি এটাকেই বিজনেস বলি। এরাই সত্যিকারের ব্যাবসায়ি। আমি এখানে কাওকে হেয় করার জন্য বা কারো সমালোচনা করার জন্য কলম ধরিনাই। শুধু ব্যাবসা বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অজ্ঞতাটুকু তুলে আনছি যাতে যারা ব্যাবসা করেন তাদের যেন উপকারে আসে। আমি দুইজন প্রবাসী বন্ধুর অঘোষিত বাণিজ্য উপদেষ্টা ছিলাম।অল্পদিনে তাদের ব্যাবসায় দ্রুত উন্নতি হয়েছিল। আমার কোম্পানির স্বার্থে প্রতিমাসে আমাদেরকে ব্যাবসা সংশ্লিষ্ট পৃথক পৃথক বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রেখেছিল।

ফলে আমি আমার দায়িত্ত্বে থাকা এরিয়া গুলির দ্রুত উন্নতি করতে সক্ষম হই। প্রচুর প্রশংসাপত্র পেয়েছিলাম কোম্পানির পক্ষ থেকে। দুঃখিত ! আমি আমার নিজের কথা বলতে আসিনি এখানে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছিল বলে যৎসামান্য বলতে বাধ্য ছিলাম।

এতক্ষন যেগুলো আলোচনা করলাম এগুলো তো একেবারে ছোট বা ক্ষুদ্র ব্যাবসায়িদের কথা। এবার একটু মধ্যমানের ব্যাবসায়ি যেমন-ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, শপিং সেন্টার, শপিংমল ও কমপ্লেক্স গুলোর কথায় আসা যাক।

এখানে মালিকের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এইক্ষেত্র গুলিতে ম্যানেজার, সুপারভাইজার, সেলস ম্যান, মার্চেন্টাইজার, ক্যাশিয়ার, সেলফ বয়, ক্লিনার ও দারোয়ান নানা শ্রেনীর ম্যানপাওয়ার থাকে। এদের সমন্বয়ে গোটা মার্কেট সচল থাকে। এই সমন্বয়তাকে বলা হয়-‘TEAM WORK’ এই টিম ওয়ার্কের কোন শাখার অবহেলা গোটা সিস্টেমটাকে অচল করে দিতে পারে। আর এটার কু-প্রভাব অবশ্যই ব্যাবসায়ে পড়বে। তাই এই জিনিসটা খুবই যত্ন সহকারে দক্ষতার সহিত পর্যবেক্ষনে রাখা উচিৎ ।

  লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.