মহাসড়কের গতি নিয়ন্ত্রণ, ফিটনেসবিহীন বাস ও লঞ্চ বন্ধের দাবী- যাত্রী কল্যাণ সমিতি

0

সিটিনিউজবিডি ডেস্ক :    ঈদ যাত্রায় মহাসড়কে গতি নিয়ন্ত্রণ, যানজট, ফিটনেসবিহীন বাস ও লঞ্চ বন্ধকরা না গেলে ঈদ আনন্দ যাত্রা বিষাদে পরিণত হবে বলে দাবী করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

আজ সোমবার (১২ জুন) সকালে রাজধানীর মুক্তি ভবনে প্রগতি সম্মেলন কক্ষে সংগঠন আয়োজিত “ঈদ যাত্রায় দূর্ভোগঃ নাগরিক ভাবনা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় এক লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাঙাচোরা সড়ক, দীর্ঘ যানজট, দূর্ঘটনা, বাসের ট্রিপ-সংখ্যা ঠিক রাখতে বেপরোয়া গতি। বর্ষায় বেহাল রাস্তার কারনে এবারের ঈদে যাত্রীদের দূর্ভোগ পোহাতে হবে। সরকারি হিসাবে এখনও ৩৭ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা।

এই ঈদে ঢাকা থেকে ৮০ লাখ, চট্টগ্রাম থেকে ২২ লাখ, সিলেট থেকে ৬ লাখ, খুলনা থেকে ১২ লাখ, রাজশাহী থেকে ৮ লাখ, রংপুর থেকে ৪ লাখ , বরিশাল থেকে ৪ লাখ লোক দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে। এছাড়াও এক জেলা থেকে অপর জেলায় যাতায়াত করবে আরো প্রায় সোয়া ২ কোটি যাত্রী। এইসব যাত্রী পরিবহনে সড়ক পথে মাত্র ৩৯,৯৪৫ টি বাস, ২৭,১১৮ টি মিনিবাস, ৩,১০,৮২১ টি প্রাইভেট কার, ৩ লক্ষ অটোরিক্সা , ৪৩ লক্ষ প্যাডেল চালিত রিক্সা, ১৫ লক্ষ ব্যাটারি চালিত রিক্সা, ৫৫ হাজার মাইক্রোবাস, ২ হাজার টেক্সিক্যাব, ৭৫ হাজার হিউম্যান হলার রয়েছে। নৌ-পথে ২৫ শত ছোট-বড় লঞ্চ, ৪০ হাজার ট্রলার, ৮২ হাজার নৌকা, ২ হাজার স্পিডবোড। রেল পথে পূর্বাঞ্চলে ৪৮ টি পশ্চিমাঞ্চলে ৪৪ টি আন্তঃনগর ট্রেনের পাশাপাশি ১২ জোড়া ঈদ স্পেশাল ট্রেন, ৭৩ টি লোকাল ও কমিউনিটার ট্রেন আমাদের যাতায়াতের বহরে রয়েছে। যা স্বাভাবিক সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৩৩ শতাংশ কম।

বাড়তি যা যোগান দেয়া হয় তা হলো সড়কে ফিটনেস বিহীন লক্কড় ঝক্কড় কিছু বাস-মিনিবাস মেরামত করে বহরে সংযুক্ত করা, সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাস দূরপাল্লার বহরে সংযুক্ত করা, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রাক পিকআপে যাত্রী বহন করা। রেল পথে প্রতিবছরের ন্যায় কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ বগি মেরামত করে বহরে সংযুক্ত করার পাশাপাশি বেশ কয়েক জোড়া ট্রেন বাড়তি সার্ভিস হিসেবে যুক্ত করা হয়। নৌ-পথে গত কয়েক বছরে বেশ কটি নতুন যাত্রীবাহী লঞ্চ বহরে সংযুক্ত হলেও তা চাহিদার তুলনায় নগন্য বলে প্রতিবেদনে দাবী করা হয়।
মহাসড়কের যানজট প্রবণ এলাকাগুলো থেকে অবৈধ স্থাপনা ও বাজার উচ্ছেদ না হওয়ায় যানজটের কারণে যাত্রীবাহী বাসগুলো কাঙ্খিত সংখ্যক ট্রিপ দিতে না পেরে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া গতিতে চালানো হয় বলেই প্রতিবছর ঈদযাত্রা মৃত্যুর মিছিলে পরিণত হয়।

গত বছর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান মতে ঈদুল ফিতরে দেশের সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ১৬৮ টি দুর্ঘটনায় ২১২ জন নিহত ৮৯৬ জন আহত হয়েছিল। ঈদুল আযহায় ২১০টি দুর্ঘটনায় ২৬৫ জন নিহত ও ১১৫৩ জন আহত হয়েছিল। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এ কারণে গতবারের ঈদেও এ সড়কে দীর্ঘ যানজট হয়েছিল। উত্তরের ১৬ জেলার যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। এবারও একই শঙ্কা রয়েছে। ২০১৫ সালে এ মহাসড়কের কাজ শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। রাস্তা প্রশস্ত করতে মহাসড়কের একপাশে মাটি কাটার কাজ চলছে। এতে একটু বৃষ্টি হলেই পুরো মহাসড়ক কর্দমাক্ত হয়ে পড়ছে। নিয়মিত যাত্রায়ও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে রাস্তায় ইট ফেলে গর্ত ভরাট করে যান চলাচলের উপযোগী করা হচ্ছে।

সবচেয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রীদের। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে চার লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে এই অংশ পার হতে লাগছে তিন থেকে চার ঘণ্টা। ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের কারণে গাউছিয়া মার্কেট থেকে ভুলতা মোড় পর্যন্ত মহাসড়ক সরু হয়ে গেছে। নির্মাণ এলাকার পর সড়ক যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তাতে স্বাভাবিক গতিতে যান চলাচল দুষ্কর হয়ে পড়েছে। গত ঈদেও এখানে দূর্ভোগে পড়েছে যাত্রীরা। এবারের ঈদেও একই আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করায় ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কে কোথাও ভাঙাচোরা নেই। সুপ্রশস্ত সড়কের মধ্যে চোখজুড়ানো সবুজ ডিভাইডার। মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই মহাসড়কের সুফল আটকে গেছে কাঁচপুর ব্রিজ, মেঘনা-গোমতী সেতু ও টোলঘর এবং কালুশাহ সেতুতে। এছাড়াও ফেনী রেলগেইট, মহিপাল নির্মানাধীন ফ্লাইওভার এলাকা অতিক্রম করতে ঘন্টার পর ঘন্টা দুর্ভোগে পরছে যাত্রী সাধারণ। এই কারণে ৩/৪ ঘন্টার যাত্রাপথে ১০/২০ ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। গত বছর ঈদে এই চার সেতুতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে ছিল।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ প্রায় শেষের পথে। এ মাসেই কাজ শেষ হবে। চার লেনের সুফল আটকে দিয়েছে অবৈধ পার্কিং ও বাজার। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহের ভালুকা পর্যন্ত দু’পাশে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। মাঝে গাজীপুরের শ্রীপুরের শালবন পথ দিয়ে পুরো মহাসড়কেই গড়ে উঠেছে অবৈধ পার্কিং। শিল্পকারখানার বড় বড় কাভার্ডভ্যান মহাসড়কেই পার্ক করায় মহাসড়কে কাঙ্খিত গতিতে চলতে পারে না যানবাহন। ময়মনসিংহের সিডস্টোর থেকে গাজীপুরের জৈনা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পথে আটটি বাজার গড়ে উঠেছে। আগের ঈদযাত্রায়ও এসব বাজার হয়ে দাঁড়ায় যানজটের কারণ। একই সমস্যা রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও।

এদিকে নৌ-পথে দূর্যোগপূর্ণ মৌসুম চলছে, প্রতিবছর ঈদে ছোট-বড় অসংখ্য দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। সরকারের নিয়োজিত ইজারাদাররা অস্বাভাবিক যাত্রী হয়রানী ও অতিরিক্ত টোল আদায়ের নামে নৈরাজ্য চালিয়ে আসে। এর পাশাপাশি ধারণ ক্ষমতার তিন থেকে চারগুন অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারনে এই পথে যাতায়াত চরম ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠে।
রেল পথে ৬৮.৩৫ শতাংশ ইঞ্জিন, ৪৬.১৪ শতাংশ কোচ মেয়াদ উত্তীর্ণ। এছাড়াও ৮০ শতাংশ ট্রেনে স্বাভাবিক সময়ে কোচ ও আসন সংকটে যাত্রীরা হেন্ডেলে ঝুলে বা ছাদে ভ্রমণে বাধ্য হয়। তার মধ্যে ঈদের এক সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ গুন বাড়তি যাত্রী যাতায়াত করলেও কার্যত বাড়তি কোন ব্যবস্থা নেই।

এমতাবস্থায় যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে, ১। রেশনিং পদ্বতিতে ছুটির ব্যবস্থা করা। ২। সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্টানে কর্মরতদের যাতায়াতের পরিবহন গুলো তাদের পরিবার পরিজন আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা। ৩। ক্রাস প্রোগ্রামের মাধ্যমে সড়ক মহাসড়ক প্রতি ইঞ্চি অবৈধ দখল ও পার্কিং মুক্ত করা। ৪। সড়কের পাশে হাট বাজার উচ্ছেদ করা। ৫। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা। ৬। টোলপ্লাজা গুলো সবকটি বুথ চালু করা। ৭। যানজট প্রবণ এলাকায় দ্রুত গাড়ি পাসিং এর উদ্যোগ নেওয়া। ৮। দূর্ঘটনা প্রতিরোধে স্প্রীটগান ব্যবহার, উল্টোপথে গাড়ী চলাচল বন্ধ করা, ফিটনেস বিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারি চালিত রিক্সা, ইজিবাইক, প্যাডেল চালিত রিক্সা, অটোরিক্সা, নছিমন-করিমন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। ৯। জরুরী সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ ও ঈদ ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্ব পালনের জন্য অমুসলিমদের ঈদ ছুটি বাতিল করা। ১০। নৌ-পথে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা। ১১। রেলপথে টিকিট কালোবাজারী বন্ধ করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী।

উক্ত গোলটেবিলে বক্তব্য রাখেন, দূর্ঘটনা প্রতিরোধ সংগঠন ফুয়ারার সভাপতি ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকরাম আহম্মেদ, বাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান ট্যাংকলরী মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহবায়ক হোসেন আহম্মেদ মজুমদার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবি সমিতির সহ সম্পাদক ব্যরিষ্টার শফিকুল ইসলাম, বিপ্লবি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা প্রমূখ ।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.