এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই::মিরসরাইয়ের গহীণ পাহাড়ে সুড়ঙ্গের সন্ধান মিলেছে। সুড়ঙ্গ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তবে প্রশাসন বিষয়টি কোন প্রাণী দ্বারা খোড়া গর্ত বলে দাবী করছেন। উপজেলার ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নুরেরঘোনা ডুল্লাছড়ি এলাকায় সুড়ঙ্গটির সন্ধান মেলে। স্থানীয়রা দীর্ঘদিন থেকে এই সুড়ঙ্গ দেখে আসলে মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) থেকে উৎসুক জনতার ভীড় লক্ষ্য করা যায় সুড়ঙ্গটিকে ঘিরে।
জনবসতি শূন্য এলাকায় কে বা কারা এই সুড়ঙ্গটি খুঁড়েছে তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও ভিন্নভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। করেরহাট-বারইয়ারহাট সড়কের করেরহাট ইউনিয়নের আকবরনগর আবাসন সড়ক পথে দেড় কিলোমিটার যাওয়ার পর বাকীপথ জমির আইল, পাহাড়ী ছড়া, উঁচুনিচু পাহাড় হয়ে পাঁয়ে হেঁটে প্রায় ৫ কিলোমিটার গেলেই সুড়ঙ্গের অবস্থান। সুড়ঙ্গটির প্রায় ২ কিলোমিটারের মধ্যে কোন জনবসতি নেই; রয়েছে পাহাড় আর ফসলী জমি।
মিরসরাইয়ের গহীণ পাহাড়ে সুড়ঙ্গটি দেখা মেলার পর স্থানীয়দের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দেওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে, ইতিপূর্বে মিরসরাইয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্য্যকলাপ চোখে পড়ার কারণে। প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালে ‘যুবকমান্ড’ নামের একটি গ্রুপ উপজেলার মিরসরাই সদর ইউনিয়নের মধ্যম তালবাড়িয়ার পাহাড়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত। মিরসরাই থানার তখনকার ওসি মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল অভিযান চালিয়ে ‘যুবকমান্ডের’ সেই আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়।
২০০১ সালে নিজামপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে আস্তানা গাড়ে ‘আল-খিদমত’ নামের একটি সংগঠনের অস্ত্রধারীরা। ২০০৭ সালে তত্ববধায়ক সরকারের সময় ভারতের সীমান্তবর্তী মিরসরাইয়ের কয়লা এলাকায় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) অস্ত্রভান্ডার ও ক্যাম্পের সন্ধান মেলে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে উপজেলার মিরসরাই সদর ইউনিয়নের তালবাড়িয়া এলাকার মন্দিরা পাহাড়ে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি বাংকার এবং পরে পাশের বদরখাঁ পাহাড়ে আরো দুটি বাংকারের সন্ধান পাওয়া যায়। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক মহামায়ার গহীন পাহাড়ে সন্ধান মেলে আরো একটি বাংকারের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সন্ধান পাওয়া সুড়ঙ্গটির আধকিলোমিটারের মধ্যে ফসলী জমি নেই, তবে ন্যাড়া কিছু পাহাড় রয়েছে। সুড়ঙ্গের সন্ধান যে পাহাড়ে মিলেছে তার পূর্ব পাশের পাহাড় ছিল ঝোঁপঝাঁড়ে পরিপূর্ণ তাই ওই পাহাড়টিতে বনায়ন করার জন্য আগাছা ও ঝোঁপঝাঁড় পরিষ্কার করার সময় সুড়ঙ্গটি দেখতে পায় স্থানীয় যুবক মনজুর হোসেন। এরপর থেকে লোকমুখে জানাজানি হতে থাকে চর্তুদিকে।
করেরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ অলিনগরের স্থানীয় যুবক মনজুর হোসেন জানান, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ড়–ল্লাছড়ি পাহাড়ে আগাছা পরিষ্কার করার সময় সুড়ঙ্গটি প্রথমে দেখতে পাই। আমি ভেতরে প্রায় ২০ ফুটের মতো প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছি। সুড়ঙ্গটির আর ভেতরে যেতে পারছিলাম না; ভেতরে অন্ধকার, পথটা সুরু এবং আঁকাবাঁকা। তবে এই এলাকায় মানুষের চলাচল ছিল না।
সুড়ঙ্গের ভেতর প্রবেশ করেন দক্ষিন অলিনগর গ্রামের অপর যুবক ইলিয়াছ শরীফ। তিনি জানান, সুড়ঙ্গের বিষয়ে তিনি সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) লোকমুখে জানতে পারেন। সুড়ঙ্গটির ভেতরে প্রায় ৩০ ফুটের মতো তিনি গিয়েছেন। তবে সুড়ঙ্গটি কত ফুট দৈর্ঘ্যরে তার শেষ পর্যন্ত কোনভাবে যাওয়া যাচ্ছে না। তবে ১০ ফুট পরপর প্রায় ৬-৭ জন লোক বসার মতো জায়গা রয়েছে। সুড়ঙ্গের ভেতরের পথ সঙ্কুচিত হওয়ায় আরো ভেতরে যাওয়ার জন্য নিচের মাটি সরালে কয়লা দেখতে পাই, তবে সুড়ঙ্গের উপরের অংশ কালো হয়ে আছে।
সাহাব উদ্দিন নামে দক্ষিণ অলিনগর গ্রামের বাসিন্দা জানান, আমি প্রায় ২৫ ফুটের মতো ভেতরে প্রবেশ করেছি। তবে পথটি আঁকাবাঁকা। ভেতরে গেলে প্রায় ১০ ফুট পরপর প্রশস্ত জায়গা রয়েছে, যেখানে ৫-৬ জন লোক অনায়াসে বসতে পারবেন। তবে সেখানে লোকজনের সমাগম ছিল বলে মনে হচ্ছে না। কারণ সুড়ঙ্গের ভিতরে ব্যাঙ আর বাদুড়েরও দেখা মিলেছে।
স্থানীয় কৃষক বেলায়েত হোসেন জানান, এই এলাকায় পাহাড়ে বনায়ন করার জন্য লোকজন এবং যারা চাষাবাদের সাথে জড়িত তারা ছাড়া অন্যকোন লোকের আনাগোনা নেই। তবে সুড়ঙ্গটি কিভাবে কে বা কারা তৈরি করছে সেই বিষয়ে আমার জানা নেই।
গৃহবধূ সাজেদা আক্তার বলেন, এই এলাকায় প্রায় দেড় বছর পূর্বে একটি ভাল্লুক দেখা যেত। তিনি সুড়ঙ্গটি ভাল্লুক করতে পারে বলে ধারণা করেন। ভাল্লুকরা এমন সুড়ঙ্গ করে সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে থাকে।
স্থানীয় কৃষক মীর হোসেন জানান, আমি দীর্ঘদিন যাবত ওই এলাকায় চাষাবাদ করে আসছি। কখনো সুড়ঙ্গটি চোখে পড়েনি। লোকমুখে শুনে তিনিও সুড়ঙ্গটি দেখতে আসেন। এই এলাকায় লোকজনের চলাচল নেই, পাহাড়গুলো ঝোঁপঝাঁড়ে পরিপূর্ণ। সুড়ঙ্গটি কারা করতে পারে সেই বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারেননি।
হিঙ্গুলী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য সাহাব উদ্দিন সুড়ঙ্গের বিষয়ে শুনেছেন, তবে তিনি এই বিষয়ে কোন তথ্য জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, ওই এলাকায় জন চলাচল নেই।
জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির বলেন, এটি সুড়ঙ্গ নয়, এটি একটি গর্ত। সুড়ঙ্গ হলে একপাশ দিয়ে প্রবেশ করে অন্যপাশ দিয়ে বের হওয়া যেত। সেখানে বিপদজনক কিছু নেই। তারপরও আমরা বিষয়টি নজরদারিতে রেখেছি। ধারণা করা হচ্ছে এটি শিয়াল বা ভাল্লুকের গর্ত হতে পারে।