মিরসরাই ট্র্যাজেডি : নানা কর্মসূচীর মধ্যে নিহতদের স্মরণ

0

এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই : দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল মিরসরাই ট্র্যাজেডির অর্ধযুগ। অর্ধযুগ বার্ষিকীতে নিহতদের স্মরন করা হয় নানা কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে। নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ আবেগ ও অন্তিমে ফুলের শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে শুরু হয় দিনব্যাপী কর্মসূচীর। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সকালে নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে বিশেষ প্রার্থনা, শিক্ষার্থীদের কালো ব্যাজ ধারণ, স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শোকর‌্যালী, স্মৃতিচারণ সভাসহ নানা কর্মসূচী পালন করা হয় আাবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে।

মঙ্গলবার সকালে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভ আবেগ’র দেওয়ালে লাগানো আদরের সন্তানের ছবি ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকেন নিহত শিক্ষার্থী তারেক হোসেনের পিতা জয়নাল আবেদীন, নয়ন চন্দ্র শীলের মা নীলিমা শীল। মিরসরাই ট্র্যাজেডির ৬ষ্ঠ বছর পরও আদরের সন্তানের এভাবে চলে যাওয়াকে ভুলতে পারছেননা স্বজনরা। শুধু তারেক কিংবা নয়ন নয় মঙ্গলবার আবেগ ও অন্তিমে এসে কাঁদেন নিহতদের আত্মীয়স্বজনরাও।

নয়ন চন্দ্র শীলের মা নীলিমা শীল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ১ ছেলে আর ২ মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। আমার কলিজার টুকরা বেঁচে থাকলে আজ বিশ বছরের যুবকে পরিণত হতো। হাল ধরতো পরিবারের। কিন্তু আদরের সন্তানকে হারানোর মধ্যদিয়ে হারিয়ে গেছে সব স্বপ্ন। আমার মতো এভাবে যেন আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়।

তারেক হোসেনের বাবা জয়নাল আবেদীন বলেন, আমার ছেলের বয়সী কাউকে দেখলে মনে পড়ে যায় তারেকের কথা। সে বেঁচে থাকলে এতোদিনে অনেক বড় হয়ে যেতো। যখনি সময় পাই আবেগের সামনে এসে বসি। আবেগে আমার ছেলের সাথে আরো ৪৫ জনের ছবি লাগানো আছে। যেখানে আমি ছেলেকে দেখতে পাই। ছেলের ছবির উপর হাত বুলিয়ে ছেলেকে আদর করি। মনে হয় ছেলে আমার সাথে কথা বলছে। কথাগুলো বলার সময় অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি।

আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক জানান, দুর্ঘটনার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঘটনাস্থলে এসে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার ৬ বছর অতিবাহিত হলেও সেই প্রতিশ্রুতি আজো বাস্তবায়ক হয়নি।

মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির নিজামী জানান, ২০১১ সালের ১১ জুলাই ছিল মিরসরাইবাসীর জন্য একটি কালো অধ্যায়। সেই দুর্ঘটনায় আনোয়ার নামে তার এক ভাতিজাও মারা যায়। যে কিনা তার কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে খেলা দেখতে গিয়েছিল। পরে দুর্ঘটনায়র মৃত্যুর পর তার দেহ গোসল করাতে গিয়ে আনোয়ারের পকেটে ১০ টাকার ওই নোট পাওয়া যায়। এর থেকে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে?

আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র তরিকুল আরফান, সাইদুল কবির জানান, এই দিনটি এলে সহপাঠীদের হারানোর বেদনা তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। তারা পাঠে মনোযোগী হতে পারেন না।

মঙ্গলবার সকালে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়, আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আবুতোরাব ফাজিল (স্নাতক) মাদ্রাসা, প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচী শুরু করে। মিরসরাই ট্র্যাজেডি উপলক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রেণী কার্য্যক্রম ও অর্ধ সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত রাখে। আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়োজনে আবেগ থেকে শোকর‌্যালী বের হয়ে আবুতোরাব বাজার পদক্ষিণ শেষে পুণরায় বিদ্যালয়ে এসে শেষ হয়।

পরবর্তীতে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে নিহতদের স্মরলে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. মোঃ ইসমাইল খান। নিহতদের স্মরণে স্মৃতিচারণ সভা বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য ও মায়ানী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম গোলাম সরোয়ারের উপস্থাপনায় ও সভাপতি মুহাম্মদ আজম খানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন উপজেলা চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) ইয়াছমিন আক্তার কাকলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়া আহমেদ সুমন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ আতাউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী।

এসময় অন্যানের মাঝে বক্তব্য রাখেন সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌস হোসেন আরিফ, মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির নিজামী, মঘাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসাইন মাষ্টার, খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদ ইকবাল চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান শাহীনুল কাদের চৌধুরী, আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক, উপজেলা স্বেচ্চাসেবকলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ হাসান। এসময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, নিহতদের স্বজন, রাজনৈতিক নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন। স্মৃতিচারণ সভা শেষে উপজেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে নিহতদের ফ্রেমে বাঁধাইকৃত ছবি নিহতদের স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করেন।

বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ ও ঘটনাস্থলে নির্মিত ‘অন্তিম’ এ ফুলের শ্রদ্ধা জানান গৃহায়নও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পক্ষে উপজেলা আ’লীগ, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা আওয়ামীলীগ, উপজেলা বিএনপি, আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়, মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদ, মঘাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন। স্মৃতিচারণ সভায় বক্তারা নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি এমন দুর্ঘটনা যাতে আর কখনো না ঘটে সেজন্য সামাজিক সচেতনতার প্রতি গুরুত্ব দেন। ১১ জুলাইকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবী জানানো হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল ফাইনাল খেলা শেষে ফেরার সময় শিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি পিকআপ বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের পাশের একটি ডোবায় উল্টে যায়। যেখানে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন, আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪ জন, আবুতোরাব ফাজিল মাদ্রাসার ২ জন, প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী ছিলো। এছাড়া ১ জন অভিভাবক ও ২ জন ফুটবলপ্রেমীও মারা যায়।

 

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.