মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর উপন্যাস ‘প্রতিপক্ষকাল’

0

মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছে প্রবাসী লেখক মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর উপন্যাস ‘প্রতিপক্ষকাল’। বেহুলাবাংলা ৭১-এর উপন্যাস সিরিজের এ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঢেকে থাকা ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। গ্রন্থের কাহিনীতেও রয়েছে ভিন্নতা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মুস্তাফিজ কারিগর। পাওয়া যাচ্ছে একুশে গ্রন্থমেলায় বেহুলা বাংলার ২৭৬ নম্বর স্টলে।

উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের এক অনবদ্য ও অনন্য জাগরণ। জাতিরাষ্ট্রের দুর্দম স্বপ্নের অগ্নিময় রক্তাক্ত উত্থান। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের অভিলাষের ফসল নয় মুক্তিযুদ্ধ। জনযুদ্ধের এই প্রেক্ষাপটে যোদ্ধা ছিল আপামর জনসমাজ। মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক- সশস্ত্র এবং সহযোগিতামূলক। আত্মত্যাগ ছিল শর্তহীন-জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম। একটি জনযুদ্ধের সামগ্রিক চরিত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে ফেলেছে গভীর রেখাপাত।

নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসনপীড়িত সময়ে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের আবহে মূলধারার সম্পৃক্ততায় কথাশিল্পের ভুবনে বিচরণ শুরু সিদ্দিকীর। মূলতঃ গদ্যশিল্পী তিনি।

লেখকের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, শঙ্খসোহাগ (গল্প-শৈলী প্রকাশন), নীলমনি (গল্প-পূর্বা প্রকাশন), আসুন, সত্যবাদীদের অভিনন্দন জানাই (প্রবন্ধ-সন্দেশ প্রকাশন), প্রলম্বিত আঁধার (উপন্যাস-সন্দেশ প্রকাশন), রাজেশ্বরীর দায় (গল্প-বলাকা প্রকাশন), তিমিরানন্দে বাংলাদেশ (প্রবন্ধ-বলাকা প্রকাশন), পলিমাটির পাঁচালী (প্রবন্ধ-বলাকা প্রকাশন), মেঘদ্রৌহী সূর্যসখা (কবিতা-বলাকা প্রকাশন)।

তার একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহতাব শফি। যা পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন :  আপনার জীবন সম্পর্কে বলুন…

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: আমি অত্যস্ত সাধারণ পরিবারের সন্তান। চট্টগ্রাম শহরের রামপুর ওয়ার্ডের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। বদরাগী বাবা আর শান্তশিষ্ঠ মায়ের ছোট সন্তান হলেও আমি আসলে ছোট ছিলাম না। আমার ছোট দুই ভাইবোন মারা যাবার পর আমিই ছোট সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠি। পড়ালেখা শুরু নতুন বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইমারী স্কুলেই আমার ডানপিটে জীবনের শুরু। পড়া না পারলে টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে স্যাররা পিঠে বেত মারতেন। একদিন বেত মারার সময় টেবিল উল্টে দিয়ে স্কুল পালাই। পরে অবশ্য ফিরে গেছি। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় ঊনসত্তুরের গণঅভ্যূত্থানের জোয়ার আসে। বড়দের সাথে পাড়া মহল্লায় জয়বাংলা মিছিলে যোগ দেই। মিছিলের সেই আগুন আমার জীবনের সিংহভাগ সময় জুড়েই ছিলো। বাবা পিডিবিতে কাজ করতেন। সে সুবাদে মনসুরাবাদ পিডিবি হাইস্কুলে ভর্তি হই ক্লাস সিক্সে। সারা বাংলাদেশের মানুষের বসবাস ছিলো পিডিবি কলোনি। আর তা আমার জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়। আমার রুচি, চালচলন, কথাবার্তা, বন্ধু-বান্ধব বদলে যায়। একদিকে চট্টগ্রামের চিরায়ত সংস্কৃতি অপরদিকে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি। আমি ক্রমশঃই বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। পড়ালেখায় গড়পড়তা ছাত্র হলেও পাঠ্যবইয়ের বাইরের পড়ার দিকে ঝোঁক বেড়ে যায়। অবশ্য প্রথম দিকে দস্যু বনহুর আর কুয়াসা সিরিজ দিয়ে শুরু। ইতিমধ্যে দেশে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু পলোগ্রাউন্ডের মাঠে ভাষণ দেন। সেদিন আমি পাগলের মতো জনসভায় যাই। সেই প্রথম আমি লাখো মানুষ দেখি। মানুষের সমস্বর শুনি। আমার চেতনার উন্মেষ ঘটে। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমার বড় ভাই এবং তার বন্ধুরা যুদ্ধে অংশ নেয় এলাকায় থেকে। আমি তাদের ক্ষুদে বার্তাবাহক হয়ে যাই। অস্ত্র দেখি, লাশ দেখি, পাকিস্তানীদের নির্যাতন দেখি, মানুষের হাহাকার দেখি। নয় মাসে আমি যেন অনেক বড় হয়ে যাই।

এরপর দেখি জাসদের উত্থান। আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুদের অনেকেই জাসদ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের যে বাংলাঘরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য শলা পরামর্শ হতো সেখানে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পোস্টার লেখা হচ্ছে। আমি বিষয়টা কেন যেন মেনে নিতে পারিনি। তবে এ সময়ে আমি সমাজতন্ত্র শব্দটির সাথে পরিচিত হই। আশ্চর্যজনকভাবে গ্রেফতার হবার দুদিন আগে আমি সিরাজ শিকদারকে এক ঝলক দেখি যদিও তখনও জানতাম না তিনি সিরাজ শিকদার। এলাকায় জাসদের সংগঠক শাহজাহান মাস্টার আমাকে কি যেন দিয়ে (ঠিক মনে পড়ছে না) বড় ভাইয়ের বন্ধু সেকান্দর ভাইয়ের বাড়িতে পাঠান। সেখানে পাজামা আর ফতুয়া পরা এক অচেনা লোককে দেখি। পরে বড় ভাইদের কথাবার্তায় জানতে পারি তিনি ছিলেন সিরাজ শিকদার। যদিও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের জন্য আমার জাসদ আর সিরাজ শিকদারকে দায়ী মনে হতো। আবার যারা আওয়ামী লীগ করতো তখন তাদের আচার আচরন কখনোই আমার মনপুত হয়নি। তাই আমি জাসদ কিংবা আওয়ামী রাজনীতিতে জড়াতে কখনো আগ্রহবোধ করিনি।

মেট্রিক পাশ করে সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হই। ইতিমধ্যে এলাকায় ক্লাব আর নাটক নিয়ে মেতে উঠি। আফরোজ আহমেদ মিরজু ভাই ছিলেন আমার নাট্যগুরু। তার পরিচালনায় বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করি। কিন্তু কলেজ জীবনে গিয়ে আমি দ্রুত বদলে যেতে থাকি। দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসরে সদস্য হয়ে পড়া আর লেখার দিকে ঝুঁকে পড়ি। তখন আসরের ভাইয়া ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউল হাকিম। আগামীদের আসরের পাতাতেই আমার প্রথম লেখা ছড়া ’পড়ার ঘরের টিকটিকিটি’ ছাপা হয়। এরপর আমি জোরালোভাবে লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়ি। কবি বিনয় মজুমদার, রবীন ঘোষ, সুনীল দে আর আশীষ দত্তের সাহচর্যে লেখালেখি গতি লাভ করলেও মুসলিম হল চত্বরের বইমেলায় প্রভাব বিস্তারের জন্য বিপ্লব বিজয় বিশ্বাসের পক্ষের সাথে প্রকাশ্যে মারামারি দেখার পর গতিমুখ ঘুরিয়ে আমি ফুলকি মুখো হয়ে পড়ি। কবি আবুল মোমেনের সান্নিধ্যে এবং কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি ওমর কায়সার, ছড়াকবি অজয় দাশগুপ্ত, কবি শাহিদ আনোয়ার, কবি ইব্রাহিম আজাদসহ একঝাঁক প্রাণবন্ত ঝলমলে প্রাণের স্পর্শে আমার সাংস্কৃতিক চেতনা শাণিত হয়। আমি গল্প আর প্রবন্ধ লেখার দিকে ঝুঁকে পড়ি।

 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে রিজুয়ান খান ও ইকবাল করিম হাসনুর অনুপ্রেরণায় সলিমুল্লাহ খানের প্রাক্সিসে যোগ দেই কিন্তু মেজর জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের ক্ষমতা দখল পরবর্তী সময় এতো দ্রুত বদলে গেলো যে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়লাম। নব্বুইয়ের গণঅভ্যূত্থান পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলাম। এ সময়কালে রাজনৈতিক লেখালেখির পাশাপাশি মৌলিক লেখাও চালিয়ে গেছি এবং সন্দেহাতীতভাবে তাতে রাজনৈতিক প্রভাব প্রকটভাবে লক্ষণীয়।

একানব্বুইয়ের পর থেকে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা হয় নি এবং কর্মোপলক্ষে এলাকার বাইরে চলে যেতে হয়। অবশ্য ইতিমধ্যে দিলরুবা ইয়াসমিনের সাথে যৌথ জীবনের সনদে সাক্ষর করে দেই। লেখালেখির বিষয়টি গদ্যসাহিত্যের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে নেই। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ”শঙ্খসোহাগ” প্রকাশিত ছড়াকবি রাশেদ রউফের শৈলী প্রকাশনা থেকে ২০০০ সালে।

প্রশ্ন :  এবার আপনার কী বই এসেছে?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: ২০১৭-র বইমেলায় এসেছে বেহুলাবাংলার ৭১ সিরিজে আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ”প্রতিপক্ষকাল।”

প্রশ্ন :  নতুন বই সম্পর্কে বলুন…

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: প্রতিপক্ষকাল আমার দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস ”প্রলম্বিত আঁধার” (২০০৫-বলাকা) গ্রামীন জনপদে মৌলবাদী অপশক্তির ভয়াল বিস্তারের ওপর ভিত্তি করে রচিত। আর প্রতিপক্ষকাল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জ্বল জ্বলে ঘটনা। উপন্যাসটিতে যুদ্ধের আবহ তৈরির যে প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে পুরো বাঙালি জাতির মনোজগত ছাড়িয়ে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপট রচনা করেছে তার গতিময় চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জাতির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন থাকলেও কর্মজীবী মানুষের রুজি-রোজগার, প্রাত্যহিক জীবনের সুর ও ছন্দ, ভালোবাসা ও মমতার বন্ধনসমূহ যেন ঘূর্ণাবর্তে পড়ে না যায় সেজন্য বুকফাটা আর্তি আর হাহাকার চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসের দেহবল্লরীতে। কিশোরের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, ধ্বংসযজ্ঞ, অসহায়ত্ব, প্রতিরোধের সাহসিকতা ও বিজয়ের স্বাদ যেমন প্রবহমান সময়কে ফ্রেমবন্দী করেছে তেমনি ব্যক্তিমানুষের চিরায়ত জীবনধারার বর্ণিল প্রহরগুলোকে চিত্রিত করেছে। বাঙালির জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি সুবিশাল এবং এর পরিধি ও ব্যাপ্তি এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ যে, চটি উপন্যাসের কলেবরে তা ধারণ করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন :  বেহুলাবাংলার একাত্তরের একাত্তর উপন্যাস সিরিজে আপনার উপন্যাস স্থান পেয়েছে, এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কি?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: বেহুলাবাংলা তার তারুণ্য দিয়ে যে সাহসিকতাকে ধারণ করেছে তাকে আমি এককথায় আমি বলবো, অসাধারণ। বাঙালি জাতির স্বাধীকারের লড়াইটি ছিলো বহুমাত্রিক এবং জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বিশাল ক্যানভাস। এই বিশাল সৃষ্টিযজ্ঞের ওপর অনেকেই কাজ করেছেন, করছেন ও করবেন তাতে সন্দেহ নেই। বাঙালি জাতি অনন্তকাল ধরেই তার মুক্তির রক্তাক্ত যুদ্ধের গৌরবগাঁথা রচনা করে যাবে। আমার বিশ্বাস, বেহুলাবাংলার একাত্তরটি উপন্যাস প্রকাশের এই দুঃসাহসিক উদ্যোগটি অক্ষয় হয়ে থাকবে। আর এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের সাথে যুক্ত হতে পেরে আমি গৌরবান্বিত বোধ করছি।

প্রশ্ন :  প্রবাসে থেকে বইমেলা কেমন উপভোগ করছেন?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: এ প্রশ্নটি আমার কষ্টের ক্ষতকে যেন আরো দগদগে করে দিলো।

প্রশ্ন :  সেকালের বইমেলা আর এবারের বইমেলার মধ্যে কোন পার্থক্য পাচ্ছেন কি?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: পরিধি ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে এবারের বইমেলা সম্পর্কে পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মারফত অনেক ইতিবাচক আলোকপাত দেখতে পেয়েছি। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক নেতিবাচক সমালোচনাও এসেছে। সংখ্যাগত আধিক্যের কারণে গুণগত মান পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ক্ষেতের ফসল গ্রামের হাটে তোলার মতো করে লেখকেরা যদি বেচা-বিক্রির কাজে নেমে যায় তা হলে তো আর প্রকাশকের প্রয়োজন থাকে না। এক্ষেত্রে মেলার আয়োজনের দায়দায়িত্ব প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। বাংলা একাডেমির উচিত মাননিয়ন্ত্রণ করা, পাইরেসি বন্ধ করা ও ভালো বাংলা প্রকাশনাসমূহকে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসভায় তুলে ধরা। ভালো প্রকাশক ও লেখকদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি লেখকদের রয়্যালটি নিশ্চিত করলেই প্রকাশকদের মেলায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া। মেলার পণ্যের যোগানদাতা প্রকাশকরা হলে ব্যবস্থাপনা কেন তাদের হবে না?

প্রশ্ন :  সুদূর আমেরিকায় কি করা হয়?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: নিছক মজুরী করি। এখানে সব কাজই কাজ। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করি।

প্রশ্ন :  উপন্যাসের পাঠক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন..

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: পৃথিবী একবিংশ শতাব্দীতে বিচরণ করলেও বাংলাদেশের জনসমাজের বৃহৎ অংশ এখনো উনবিংশ কিংবা বিংশ শতকের ঘোরবন্দী হয়ে আছে। বাংলাদেশের পাঠকসমাজ মূলতঃ মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। মধ্যবিত্ত জীবনের ঈপ্সিত আকাঙ্খা, স্যাঁতস্যাঁতে আবেগ, ইউটোপিয়ান ভাবালুতা, উচ্চবিত্তের সিঁড়িভাঙার নিরন্তর হাহাকারঅঙ্কিত উপন্যাস বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পাঠকদের মনের খোরাক। তবে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবাদে সহজলভ্য হয়ে পড়া বহুজাতিক বিনোদনীয় উপকরণও মধ্যবিত্তসমাজ আয়ত্ব করে নিয়ে নিজেদের উচ্চবিত্তের সমান্তরালে নিয়ে যাবার উদগ্রতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। তাদের কাছে বাঙালী সংস্কৃতি এখন নিছক সামাজিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার লোকদেখানো চর্চায় পরিণত হচ্ছে। সুতরাং মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক যে পাঠক সমাজ গড়ে উঠেছিলো তা বিকশিত হবার পথ সংকুচিত হয়ে আসছে। এমতাবস্থায়, আমাদের সমাজের বিশাল নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনসমাজ রয়েছে তাদের মধ্যে সাহিত্যের সীমানাকে বিস্তৃত করতে হবে। এই বর্গের শিক্ষিত প্রতিনিধিরা প্রযুক্তিগত সুবিধা গ্রহণ করে শিক্ষাকে তাদের আত্মমুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী হবে আমাদের জীবনসংশ্লিষ্ট উপন্যাসের নিমগ্ন পাঠক।

প্রশ্ন :  বছরের অন্য সময় প্রকাশ না করে মেলায় কেন?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: মহান একুশকে আমরা বইমেলা ও শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের বারোয়ারী আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছি। ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য-অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং লক্ষ্য-শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা-থেকে এই বারোয়ারী আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অভিভাবক বাংলা একাডেমি যার একান্ত কর্তব্য হলো বাংলা ভাষা বিকাশে নিরন্তর কাজ করা, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ও সমাজের সার্বিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা এবং বাংলা ভাষায় সৃষ্ট সকল উন্নতমানের সাহিত্য ও গবেষণাকে বিশ্বপরিমণ্ডলে উত্থাপন করা। কিন্তু এসব সৃজনশীলতার পরিবর্তে বাংলা একাডেমি নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বইমেলাকেন্দ্রিক করে ফেলেছে এবং একাডেমির নির্দেশনাতেই প্রকাশকরা একুশকে কেন্দ্র করে তাদের কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছে। সারাবছর বই প্রকাশিত হওয়া উচিত এবং এর বিপণন, বিতরণ প্রভৃতির দায়িত্ব প্রকাশকদেরই হওয়া উচিত। তাহলে সৃজনশীলতায় প্রতিযোগিতা আসবে এবং উৎকৃষ্ট প্রকাশনার সংখ্যাও বাড়বে।

প্রশ্ন :  আপনার ছোটবেলার কথা জানতে চাইবো। আপনি সাহিত্যে এলেন কেন এবং কিভাবে?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: ছোটবেলার কথা জীবনবৃত্তান্তে কিছুটা উল্লেখ করেছি। আসলে দস্যু বনহুর ও কুয়াসা সিরিজ দিয়ে আমার পঠন-পাঠন শুরু হয়েছিলো। পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হওয়া, নাটক করা, রাজনৈতিক সাহিত্যপাঠ, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন এবং খুবই ঘনিষ্টভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযুদ্ধ দেখার সুবাদে লেখনীকে প্রতিবাদের ভাষা করে তোলার ইচ্ছাতেই সাহিত্যচর্চা।

প্রশ্ন :  সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রেরণা বা প্রভাব…

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: অনেকের কাছ থেকেই আমি সরাসরি প্রেরণা পেয়েছি: বন্ধু কবি শাহিদ আনোয়ার, শিল্পী ঢালী আল মামুন, কবি আবুল মোমেন, অধ্যাপক তপনজ্যোতি বড়ুয়া, ড. অনুপম সেন, প্রফেসর চৌধুরী জহুরুল হক, সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত, রিজুয়ান খানসহ আরো অনেকে। পরোক্ষভাবে ম্যাক্সিম গোর্কি, দস্তভয়স্কি, লেভ তলস্তয়, ভিক্টর হুগো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, কার্ল মার্কস, লেনিনসহ প্রচুর বামপন্থী ও মানবতাবাদী লেখকের সৃষ্টি ও দর্শন আমার লেখার প্রেরণা হয়ে এসেছে।

প্রশ্ন :  চলছে ভাষার মাস, পাঠকদের কি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইগুলো পড়া উচিত নয়?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: আসলে আমরা খুব সহজেই সবকিছুকে বিধিবদ্ধ করে ফেলতে চাই। ভাষা কিংবা বিজয়ের মাস এলেই কেন আমাদের ভাষা ও বিজয়ের স্মরণ করতে হবে? এটি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। পঠন-পাঠনের বিষয়গুলোকে উন্মুক্ত রাখাটাই শ্রেয়।

প্রশ্ন :  আমাদের দেশে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা কী? আপনার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলুন…

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: আমাদের সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো চিন্তা চেতনা ও শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, আর্থিকভাবে সমাজের এই বিশাল জনগোষ্ঠী জীবনধারণের বাইরে বিনোদনের জন্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে নি। তাই পাঠকবৃদ্ধির জন্য বইমেলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে মেলা হওয়া উচিত দেশব্যাপী এবং প্রকাশকদের উদ্যোগে।

প্রশ্ন :  প্রকাশকদের নিয়ে আপনার অভিমত কি?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: এটি এক দুরূহ প্রশ্ন। তবুও বলতে হয়, আমাদের প্রকাশনা শিল্প প্রকৃত অর্থে শিল্প হয়েই ওঠেনি। প্রকাশকরা মূলতঃ লেখকের কন্ট্রাক্টর হিসেবেই ভুমিকা পালন করছেন। লেখক নিজের পণ্য দিচ্ছেন এবং পণ্যটি মোড়কজাত করে হাটে তোলার জন্য প্রকাশককে টাকা দিচ্ছেন। প্রকাশক নিজের বাণিজ্যিক স্বত্ব ব্যবহার করে পণ্যটি প্রদর্শন করছেন। তার অর্থ হলো প্রকাশকের নিজের কোন বিনিয়োগ নেই। পুঁজিই যদি বিনিয়োগ করা না হবে তাহলে তাকে কিভাবে শিল্প বলা যাবে? কারণ প্রকাশক তো কোন ঝুঁকি নিচ্ছেন না। আর ঝুঁকি না নিয়ে যে ব্যবসা হয় তাকে ফটকা ব্যবসাই বলে বাণিজ্যিক ভাষায়। সুতরাং প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে দাঁড় করাতে হলে প্রকাশকদের ব্যবসার ঝুঁকি নিতে হবে, লেখকের রয়্যালটি নিশ্চিত করতে হবে, বাজার সৃষ্টি করতে হবে।

প্রশ্ন :  কোন কোন ব্যাপারে মনঃক্ষুন্নতা আছে আপনার?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: মানুষ হিসেবে আমিও সহজাত মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বাইরে নই। আমি খুবই ক্ষুন্ন হই যখন আমি লেখার সময় পাই না, পড়ার সময় পাই না কিংবা শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও বইমেলায় যেতে পারি না। আমি ক্ষুন্ন হই যখন কোন আপনজন ভুল না ভাঙিয়ে ভুল বোঝে।

প্রশ্ন :  সাহিত্যে প্রবন্ধ বা গবেষণার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ”কুমুর বন্ধন” পড়ার পর আমার প্রবন্ধ লেখার দিখে ঝোঁক আসে। তারপর বিনয় ঘোষের মেট্রোপলিটন মন পড়ার পর প্রবন্ধ লিখতে ইচ্ছে হয়। আহমদ ছফা’র বাঙালি মুসলমানের মন, আহমদ শরীফের তীক্ষ্নধার লেখনী, হুমায়ুন আজাদের বাঙলাভাষার শত্রুমিত্র প্রভৃতি প্রবন্ধ সাহিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাহিত্যের মানোন্নয়নের জন্য, সাহিত্য বিচারের জন্য এবং তুলনামূলক সাহিত্য বিশ্লেষণের জন্য সাহিত্য গবেষণা অপরিহার্য।

প্রশ্ন :  সাহিত্য নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: লেখা, লেখা, শুধু লেখা।

প্রশ্ন :  আপনার বন্ধু বা পরিচিতজনদের কি কি বই আসছে?

মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী: জানামতে ফকির ইলিয়াসের একটা বই বেরিয়েছে বেহুলাবাংলা থেকে, তাছাড়া দর্পন কবিরের আমি ভূত বলছি, তমিজউদ্দিন লোদীর কবিতার বই, হোসাইন কবিরের কবিতার বই, সাংবাদিক আমানউদ্দৌলা সম্পাদিত ”পঁচিশ বছর পরে” নির্মূল কমিটির একটি সংকলন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.