রোহিঙ্গাদের দূদর্শার নাম আরসা 

0

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার,সিটিনিউজ :: আরসা বা আল ইয়াকিনের নাম শুনলে আতকে উঠে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে যে সংগঠনটি ৩০টি পুলিশ চেকপোষ্টে হামলা চালিয়েছে সেই সংগঠনটির নাম ‘আরাকান রোহিঙ্গা সলভেনশন আর্মি আরসা’।

তবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৯০ ভাগ মানুষই ‘আরসা’ বললে বুঝতে পারে না। এটা আবার কি! ফ্যাল ফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে। তবে ‘আল ইয়াকিন’ বললেই অনায়াশেই তারা বুঝতে পারে এবং কথা বলতে শুরু করেন। রোহিঙ্গারাই এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী গ্রুপ বলে আখ্যা দিচ্ছে। পেছনের মৃত্যুর উপত্যকা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুর্দশার নাম ‘আল ইয়াকিন’।

এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনটির কারনে মিয়ানমারের রাখাইনের লাখ লাখ রোহিঙ্গা শুধু তাদের সাত পুরুষের ভিটা-মাটি হারায়নি, দেশ থেকেও বিতারিত হয়ে ভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ও বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বছর আগেই প্রথম ‘আরাকান রোহিঙ্গা সলভেনশন আর্মির (আরসা বা আল ইয়াকিনের)’ নাম প্রথম শোনা যায়। এই সংগঠনের নেতা আতাউল্লাহ রোহিঙ্গা বংশদ্ভোত একজন পাকিস্থানী নাগরিক। সৌদি আরবের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। পাকিস্থান ও সৌদি আরবে থেকেই আতাউল্লাহ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে নিয়ে সেখানে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে আসছিল।

রোহিঙ্গারা জানায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমে আরসার নাম শোনা যায়। তারা এসময় রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি স্থানে সরকারী বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সুচি সরকার সব ক্ষেত্রে আরো কড়াকড়ি ও কঠোর নজরদারী আরোপ করেন। এর আগে রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৪২ সালের পর থেকেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু সেটার কোন পরিবর্তন হয়নি।

এলক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে তারা সংগঠন গড়ে আন্দোলনের প্রস্তুতিও নেয়। কিন্তু কখনোই আন্দালনে গতি আসেনি, বার বার পেছনে হটগে ত হয়েছে। আরসা নেতা আতাউল্লাহ সহ কোন সংগঠনের নেতারাই এখন পর্যন্ত বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কোন ধরনের আশার খবর তো দিতেই পারেনি। সর্বশেষ আতাউল্লাহর নেতৃত্বাধীন আরসার অপরিকল্পিত হামলা সহ অপরাধ কর্মকান্ডের কারনে এখন লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে এক কাপড়ে, অনাহারে দেশ ছাড়া হতে হয়েছে।

আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে মিয়ানমারের আভ্যন্তরে আরসাকে অনেক বড় বিদ্রোহী সংগঠন বলে খবর প্রকাশিত হলেও বাস্তবে আল ইয়াকিন একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন। এই সংগঠনের কাছে মিয়ানমার আর্মি ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপিকে মোকাবেলা করার মতো কোন অস্ত্র নেই। তাদের সম্বল ধারালো অস্ত্র আর হাতে তৈরী কিছু বোমা। গত ২৪ আগষ্ট রাতে রাখাইন রাজ্যের ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে এসব বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। একই সঙ্গে ধারালো অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় সেখানে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।

সুত্র মতে, আরসা এখনো সামরিক ভাবে অন্যন্যা দেশের সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মতো প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেনি। তারা গত এক বছরে ৩ বার সন্ত্রাসী হামলা চালায়। হামলার পর আর তাদের কোন খোঁজ থাকে না। তারা পালিয়ে বড় পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হামলা পরবর্তী সময়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে।

চলতি বছর ২৪ আগষ্টের হামলার পর হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা ও নির্যাতন এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গার দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত আরসার আর কোন কর্মকান্ড দেখা যায়ািন। মংডু ও বুচিডং এলাকায় আরসার সক্রিয়তা বেশী নজরে পড়ে বলে স্থানীয় একটি সূত্রে জান গেছে। তবে আকিয়াব এলাকায় আরসার বিশেষ কোন সক্রিয়তা রোহিঙ্গারাও দেখেনি।

বাস্তবে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস বা আল কায়দার সঙ্গেও এদের কোন যোগাযোগ নেই। রোহিঙ্গাদের সংগঠন এআরএনও নেতারাও আরসাকে সমর্থন করে না। আরসার কার্যক্রম বা গঠরে ব্যাপারে তাদেরও কিছুই জানা নাই।

একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, আরসা শেল্টার নেয়ার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তাদের ধারনা ছিল এ ব্যাপারে বাংলাদেশ তাদের সহযোগীতা করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলে নিরাপদে প্রশিক্ষণ নেবে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরন হয়নি।

এদিকে, এই আরসার সদস্যরা সুবিধা করতে না পেরে তারা ভারতের মিজোরামের কাছে মিয়ানমার-মিজোরাম সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। মিজোরামের নিকটববর্তী গভীর পাহাড়ি এলাকায় থেকেই সংগঠিত হয়ে রাখাইর রাজ্যে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে এমন ধারণা অনেকের। এক সময় আরএসও বা মুজাহিদ লোকজনের কাছ থেকে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র সংগ্রহ করতো। কিন্তু বর্তমান আরসা এখন অস্ত্র সংগ্রহ করছে। তাদের অস্ত্রের কোন ভান্ডারই এখন পর্যন্ত তৈরী হয়নি বলে সুত্রে প্রকাশ। মিয়ানমারের রাখাইনে আরসার কার্যক্রমে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোািহঙ্গা শরনার্থীদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

টেকনাফে পালিয়ে আসা মংডুর টংবাজার এলাকার বাসিন্দা ফয়জুল্লাহ’র জিজ্ঞাসা- ‘আল ইয়াকিন’ আসলেই কি রোহিঙ্গাদের ভালো চায়। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে চায়, তারা কি পারবে। ‘আল ইয়াকিন’ নেতা আতাউল্লাহ কি আসলেই একজন মুসিলমান’! যদি সে মুসলামান হয় তাহলে আমাদের রোহিঙ্গাদের) এতোবড় ক্ষতি কেন করলো।

জানা গেছে, আরসা বা আল ইয়াকিন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রথম কোন সংগঠন নয়। ষাটের দশকে প্রথম রোহিঙ্গাদের সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠনের নাম ছিল ‘রোহিঙ্গা পেট্ট্রিয়টিজ ফোরাম (আরপিএফ)। ডিএ জাফরউল্লাহ ছিল সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। সত্তর দশকে এই সংগঠনটিতে বিভাজন দেখা দেয়। শেষতক ভেঙ্গেও যায়। এরপরই গড়ে ওঠে নতুন সংগঠন ‘রোািহঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) ডাঃ ইউনুস এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ও সালামত উল্লাহ সেক্রেটারী হন।

অপরদিকে নুরুল ইসলাম গঠন করে আরাকান ইসলামিক রোহিঙ্গা ফোরাম (এআইআরএফ)। উভয় সংগঠন তৎপর থাকলেও বিভক্তির কারনে প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গাদের কোন উপকার হয়নি। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলার পর ২০০০ সালের দিকে আরএসও এবং এআইআরএফ আবার একত্রিত হয়। গড়ে ওঠে আরো একটি রোহিঙ্গা সংগঠন। এই সংগঠনের নাম হয় ‘আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অরগানাইজেশন (এআরএনও)।

এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হন নুরুল ইসলাম। সামরিক শাখার দায়িত্ব পায় সলিমুল্লাহ প্রধান। মিয়ানমার আর্মির চাপের মুখে সলিমুল্লাহ কক্সবাজারের পালিয়ে আসে। এদেশীয় কিছু সলিমুল্লাহ চট্টগ্রামের বহদ্দার হাটে এসে আশ্রয় নেয়। ‘মমতানীল’ নামের একটি বাড়ি থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর এই সংগঠনের নেতারা কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে যায়। আরএসও নেতা মাষ্টার আয়ুব পাড়ি দেন সৌদি আরবে।

অনেকে গোপনে এদেশে অবস্থান করে কৌশলে নাগরিকত্ব নেয়। এছাড়া আরএসও জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত হন টেকনাফ বাহারছড়ার মৌলভী আজিজ উদ্দিন, মৌলভী রফিক উদ্দিন, হাফেজ ছলাউল ইসলাম, সৌদি নাগরিক আবু সালেহ আল গাদ্দানি, টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুরের মৌলভি সৈয়দ করিম ও টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার মাওলানা ইব্রাহিম, টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুরানপাড়ার মৌলভী নাসির উদ্দিনের ছেলে মৌলভী রফিক উদ্দিন, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভী আজিজ উদ্দিন, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এর সামরিক কমান্ডার রোহিঙ্গা নেতা মাষ্টার আয়ুব, সালামত উল্লাহ, মৌলভী আবদুর রহমান, আবু বক্কর, ডাঃ ইউনুচ ও ডাঃ নুরুল আমিন সহ আরো অন্তত ৩০ জন এদেশীয় নাগরিক।

এরা বাংলাদেশের অখন্ডতা জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন, জনসাধারণের মধ্যে আতংক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হত্যা, গুরুতর জখম ও অপহরণ রাষ্ট্রের সম্পত্তি ক্ষতি সাধন তথা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য অর্থ সংগ্রহের ষড়যন্ত্রমুলক গোপন পরিকল্পনা ও আশ্রয় দানে জঙ্গী সংগঠন আরএসও’র সাথে গোপন বৈঠক করতো প্রায় সময়। এদের অনেকে গ্রেফতারও হন। সংগঠনের নুর ইসলাম আমেরিকায়, ডাঃ ইউনুস বৃটেনে এবং মাহমু কানাডায় রয়েছে। এসব সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় থাকা মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে থাকা নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে এখনো মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে।
রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে আল ইয়াকিনের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা ভীষন রকমের দূর্বল। সেখানে তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে রোহিঙ্গা যুবকদের সংগঠিত করছে। কেউ কেউ আল ইয়াকিনের সদস্যদের দেখেছেন।

রাখাইন প্রদেশের বুচিডং এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আব্দুর রহিম জানান, আমরা আল ইয়াকিন দেখিনি, তবে শুনেছি। আল ইয়াকিন নেতা আতাউল্লাহ সম্পর্কেও বেশীরভাগ মানুষের কোন ধারনা নাই। যারা একটু শিক্ষিত শুরু তারাই জানেন। কিছু যুবক ছেলে আল ইয়াকিনে যোগ দিয়েছে। রাতের বেলায় আল ইয়াকিনের সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বদলে দেয়ার নানান গল্প শোনায়।

সহযোগীতা ও আস্থা বাড়াতে কোন কোন পরিবারকে চালের বস্তা দিয়ে যায়। আবার অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের কাছ থেকে আল ইয়াকিনের সদস্যরা তাদের সংগঠনের কাজ চালানোর জন্য নগদ টাকা ও গরু নিয়ে গেছে বলেও অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মংডুর ফকিরাপাড়ার সিরাজুল ইসলাম জানান, রাতের বেলায় আল ইয়াকিন এর লোকজন আসে। আবার দিনের বেলায় আল ইয়াকিনের খোঁজ জানতে আমাদের কাছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আসে।

মংডুর চিকনগুণিয়া এলাকার বারিসন্দা আব্দুল মেরাজ জানায়, তার পরিচিত একটি পরিবারের তিনজনকে আল ইয়াকিন এসে জোর করে নিয়ে গেছে। আল ইয়াকিনকে আমরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তারা তখন আমাদের সাহস দিয়েছে। রাখাইনে প্রথম হামলার পরে শুনেছি তাদের সাংগঠনিক অবস্থা মোটেই ভালো না।

মংডুর চিকনগুনিয়া এলাকার থেকে পালিয়ে বালুখালি ক্যাম্পে আসা গৃহবধু রাহেলা বেগম ও নুরজাহান বেগম জানান, মাঝে মাঝে আল ইয়াকিনের লোকজন রাতের বেলায় তাদের গ্রামে আসতো। তারা কখনো দিনের বেলায় আসতো না। তারা বলতো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। এজন্য আমাদের লোক দরকার। তোমাদের যুবক ছেলেদের আমাদের সঙ্গে কাজ করতে দাও। এভাবে তারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক যুবককে পাহাড়ে নিয়ে যায়।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.