সংসদ নির্বাচনে হেফাজতের প্রস্তুতি !

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটিনিউজ : বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নাড়া দিতে সক্ষম হওয়া ইসলামিপন্থী অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ছোট-বড় অনেক ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতারা আবার হেফাজতের গুরুত্বপুর্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন কারনে আলোচিত হেফাজতে ইসলামের নেতারা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন হেফাজতে ইসলামের অন্তত ৫০ জন কেন্দ্রীয় নেতা।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত বিভিন্ন ইসলামিপন্থী দলের অধীনে তারা বিভিন্ন আসন থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহন করবেন। যদিও কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক মৌলবাদী ও ইসলামিপন্থী গ্রুপটি দাবী করে আসছে, তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। আর ইতিমধ্যে গ্রুপটির কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন সময় স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। ফলে দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইসলামিপন্থী রাজনীতিবিদরা হেফাজতে ইসলামকে একটি গুরুত্বপুর্ন ভোট ব্যাংক হিসেবে দেখছেন। গ্রুপটির পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, তাদের দলের কোনও নেতার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। যদিও বিভিন্ন দাবী বাস্তবায়নে গ্রুপটির কেন্দ্রীয় নেতারা নিরবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন।

সংগঠনটির একটি সুত্র জানিয়েছে, সংগঠনটির ১৩ দফা দাবী বাস্তবায়নে নির্বাচনে অংশগ্রহনকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন নেতারা। ২০১০ সালে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলাম গঠন করা হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসাকে সংগঠনটির হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম পরিচিতি পায়। এরপর থেকে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করা ও নাস্তিকদের মৃত্যুদন্ডের দাবীসহ ১৩ দফা দাবি জানিয়ে আসছে তারা।

সংগঠনটির আমির শাহ আহমেদ শফি বিভিন্ন সময় বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক দল নয় এবং আমরা কোনও নির্বাচনে অংশগ্রহন করবো না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে, হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতা কেন্দ্রীয় নির্দেশে বিভিন্ন সরকারী অফিস ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

যাদের মধ্যে ২০১৪ মাসে হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন সংগঠনটির চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌরসভা ইউনিটের সাধারন সম্পাদক নাসির উদ্দিন মুনির। হেফাজতে ইসলামের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,’ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে সংগঠনটি দেখাতে চায়, তারা সাধারন মানুষের মধ্যে কত জনপ্রিয়’।

যেসব ইসলামি দল থেকে হেফাজত নেতারা প্রার্থী হতে চান. সেগুলো হলো নিজাম-ই-ইসলামী পার্টি, জমিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ (ইসহাক), খেলাফত মজলিশ (হাবিবুর রহমান), খেলাফত ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের দুটি অংশ। সুত্র জানিয়েছে, হেফাজতে ইসলাম এখন ৫০টি আসনে তাদের প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের নাম বিবেচনাধীন আছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধ ও মামলার অভিযোগ খতিয়ে দেখছে সংগঠনটি।

একজন হেফাজতের নেতা জানান, যারা নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক তাদের নাম চুড়ান্ত করবেন সংগঠনটির প্রধান শাহ আহমাদ শফি এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা। কারন কেন্দ্রীয় এই নেতাদের সঙ্গে সরকার, বিএনপি ও অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তিনি আরও জানান, সংগঠনটির নেতারা অন্য দলের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলেও তাদের হেফাজতের পরিচয় বহাল থাকবে বলে আশা করছি। জানা গেছে, সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা ইতিমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে মিটিং করেছেন। এ ছাড়া গ্রুপটি জনমত জরিপের চেষ্টা করছে।

এমনকি আগামী নির্বাচনকে লক্ষ্য করে একটি কমিটিও গঠনের পরিকল্পনা করছে তারা। সুত্র জানায়, যারা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী গ্রহন করবে এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করবে, শুধুমাত্র তাদেরই সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্বাচন করার অনুমতি দেওয়া হবে। আগামী নির্বাচনে কমপক্ষে ৫০টি আমনে বিজয়ী হওয়ার পরিকল্পনা করছে গ্রুপটি। সুত্র জানায়, হেফাজতের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অন্যতম লক্ষ্য ১৩ দফা দাবী সংসদে তোলা। কারন অনেক দাবী বাস্তবায়নে পৃথক আইন করার দরকার রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যদি সংসদে আমাদের লোক থাকে, তাহলে তারা সংসদে আমাদের ১৩ দফা দাবী উত্থাপন করতে পারবেন। সুত্রটি জানিয়েছে, সংগঠনটি এমন নেতাদের চাচ্ছে যারা ভবিষ্যতে হেফাজতের জন্য কাজ করতে দায়বদ্ধ থাকবে। আগামী নির্বাচনে হেফাজত নেতাদের অংশগ্রহনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্যজোটের সাধারন সম্পাদক এবং হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ন সম্পাদক মুফতি ফায়জুল্লাহ বলেন, ’আমি হেফাজত ইসলামের প্রার্থী নেই। তবে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী।

আমি চট্টগ্রাম-৬ (রাঙ্গুনিয়া) আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছি। তিনি আরও বলেন, ’হেফাজত নেতা হিসেবে আমরা আমাদের পরিচয় লুকানোর চেষ্টা করছি না। কিন্তু আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থেকে নির্বাচন করবো। একাত্তরের ঘাটক দালাল নির্মুল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, হেফাজত নেতারা সংসদে গেলে সেটা হবে অপরাধীদের সংসদ। আমরা এ অবস্থা চাই না এবং এ বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করছি, সরকার এ বিষয়টি বিবেচনায় থারবে।

সুত্র জানিয়েছে, ইসলামী ঐক্যজোট থেকে যসব হেফাজত নেতা নির্বাচনে অংশ নেবেন, তারা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারেন। যদিও গত বছর সংগঠনটি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ত্যাগ করে। ইসলামী ঐক্যজোটের একটি সুত্র জানিয়েছে, তারা সংসদে ১০টি আসনের জন্য সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লবিং করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, হেফাজতের নেতারা বিএনপির সঙ্গে থাকতে চান এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা আগেও নির্বাচন করেছিল।

এবারও যদি তারা নির্বাচন করতে চায় তবে তারা বিএনপির টিকিটি নিতে চাইবে না। আওয়ামী লীগ থেকে টিকিট নিতে চাইবে এবং আওয়ামী লীগের উচিত হবে তাদের টিকিট দেওয়া। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ন সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।

সুত্র মতে, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা ও নেজাম-ই-ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম-১৫ বাঁশখালী থেকে নির্বাচন করতে পারেন। এর আগে তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তখন সংগঠনটির তৎকালীন প্রধান মুফতি ফজলুল হক আমিনী সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাকে দল থেকে বাদ দেন।

ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় যুগ্ন-সাধারন সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম ইউনিটের সভাপতি মহিউদ্দিন রুহি চট্টগ্রাম-৪ (হাটহাজারি) থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন। তিনি হেফাজতে ইসলামের যুগ্ন সম্পাদক এবং দলের ক্ষমতাবান নেতা। ইসলামী ঐক্যজোটের সাধারন সম্পাদক এবং হেফাজতের সেন্ট্রাল কমিটির যুগ্ন সাধারন সম্পাদক মুফতি ফয়জুল্লাহ চট্টগ্রাম-৬ (রাঙ্গুনিয়া) আসন থেকে নির্বাচন করবেন। ইসলামী ঐক্যজোটের সভাপতি এবং হেফাজতের সেন্ট্রাল কমিটির উপদেষ্টা মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী নরসিংদী-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন।

জমিয়াতে উলেমা-ই-ইসলামের নির্বাহী সভাপতি এবং হেফাজতে ইসলামের নায়েব-ই-আমির মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস যশোর-৫ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন। তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধ করার অভিযোগ আছে। এমনকি তিনি কয়েকবার বিভিন্ন মেয়াদে জেলেও ছিলেন। ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ন সম্পাদক এবং হেফাজতের গাজীপুর ইউনিটের সাধারন সম্পাদক মাওলানা ফজলুর রহমান গাজিপুর-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন।

২০১৩ সালে গাজিপুরে হেফাজত ইসলামের আন্দোলনে প্রধান ভুমিকা পালন করেন এবং সরকার উৎখাতের ঘোষনা দেন। ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক প্রধান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং হেফাজতের ঢাকা সিটির সাধারন সম্পাদক আবুল হাসনাত আমিনী ব্রাম্মনবাড়িয়া-২ থেকে নির্বাচন করতে পারেন। লালবাগে তার মাদ্রাসা হেফাজতের ঢাকা ইউনিটের হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহুত হয়।

ইসলামী ঐক্যজোটের অফিস সেক্রেটারী ও হেফাজতের সহকারী সাধারন সম্পাদক মুফতি আলতাফ হোসেন কুমিল্লা-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন। তিনি সরকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এবং সরকার, হেফাজত ও ইসলামী ঐক্যজোটের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে ভুমিাক পালন করেন।

ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় নেতা ও হেফাজতের নবীনগর ইউনিটের সভাপতি মাওলানা মেহেদি হাসান ব্রাম্মনবাড়িয়া-৫ থেকে নির্বাচন করতে পারেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে আছেন এবং নবীনগরের সম্পদশালী ব্যবসায়ী।

ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হামিদ মুন্সিগঞ্জ-১ থেকে নির্বাচন করবেন। তিনি এলাকায় মধুপুর পীর নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেন। এ ছাড়াও নির্বাচনকে সামনে রেখে আরও অনেক গুরুত্বপুর্ন হেফাজতের বিভিন্ন স্তরের নেতা ইতিমধ্যে মাটে নেমেছেন। তারা সামাজিক অনুষ্টানাদিতে নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছেন।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.