সীতাকুন্ডের সাধন কুঠির থেকে ছায়ানীড় : কৌশল পাল্টাচ্ছে জঙ্গিরা

0

জুবায়ের সিদ্দিকী- 

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড পৌর এলাকার প্রেম তলায় ’ছায়ানীড়’ ভবনের জঙ্গি আস্তানায় তল্লাশি চালিয়ে গত ১৮ মার্চ দুপুরে কয়েকটি শক্তিশালী বোমা সহ ছোট বড় ১৫টি বোমা উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ওই বাসায় ছয়টি কন্টেইনার ভর্তি তরল পদার্থ পাওয়া গেছে। এগুলো এসিড বলে ধারনা করেছে পুলিশ। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বোমা নিস্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ’ছায়ানীড়’ এর নিচ তলায় জঙ্গিদের ভাড়া নেওয়া ওই বাসায় তল্লাশি শুরু করে।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা দুপুরে বলেন,’ একটি কক্ষের তল্লাশি শেষ হয়েছে। ওই কক্ষে ১৫টির মত ছোট বড় বোমা এবং কিছু সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। আরও কক্ষে তল্লাশি করা হবে। উদ্ধার করা বোমার মধ্যে একটি পৌনে ২টার দিকে বিস্ফোরন ঘটিয়ে নষ্ট করা হয় বলে জানান সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউর রহমান। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (সদর) হাবিবুর রহমান জানান,’ তল্লাশির শুরুতে প্রথম কক্ষ থেকে ছয়টি কন্টেইনারে থাকা তরল পদার্থ উদ্ধার করা হয়। এগুলো এসিড কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আগেরদিন বৃহস্পতিবার সারাদিন ওই বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ১০টি বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে নষ্ট করে পুলিশ।

এর মধ্যে চারটি ছিল সুইসাইড ভেস্ট। শনিবার সকাল থেকে জঙ্গি দম্পত্তি জসিম ও আর্জিনাকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে। সীতাকুন্ড নামার বাজারে ’সাধন কুঠির’ ভবনের বাসা থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেফতারের ঘটনায় সন্ত্রাস বিরোধী ও অস্ত্র আইনের দুই মামলায় ওই দুজনকে ১২ দিনের রিমান্ডে পায় পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নেওয়া একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান,’ সাধন কুঠিরের ওই বাসায় অভিযান চালানোর আগেই সেখান থেকে রাশেদ ও হৃদয় নামে দুজন পালিয়ে যায়। জসিম ও আর্জিনাকে ধরার পর তাদের দেওয়া তথ্যে প্রেম তলা এলাকার বাড়ি ছায়ানীড়ে অভিযান চালায় পুলিশ। রাতভর ঘিরে রাখার পর বৃহস্পতিবার ভোরে অভিযানে নামে সোয়াত।

অভিযানের সময় গুলি এবং জঙ্গিদের ঘটানো এক বিস্ফোরনে এক শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন। পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন.’ছায়ানীড়’এ নিহত পাঁচজনের মধ্যে দুজনের প্রাথমিক পরিচয় তারা পেয়েছেন। এরা হলে কামাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী জোবাঈদা। তাদের বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে। ওই দুইজন জসিম ও তার স্ত্রীর আত্বীয় জানিয়ে রেজাউল মাসুদ বলেন.’এসবই প্রাথমিক তথ্য। আমরা এগুলো খতিয়ে দেখছি। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেছিলেন,’নিহত জঙ্গিদের মধ্যে দুইজন জসিমের আপন বোন ও বোন জামাই হতে পারে। অন্য দুইজন ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ দুই খালাতো ভাই হতে পারে।

এদিকে সীতাকুন্ডে জঙ্গি অভিযানে নিহত কামাল ও জোবাঈদা ইয়াছমিন দম্পত্তির বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে তাদের বাবা-মার সাথে কথা বলেছে পুলিশ। তাদের সুত্র মতে, ’প্রায় নয়মাস আগে তারা বাইশারী ইউনিয়নের যৌথখামার পাড়া থেকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে চট্টগ্রাম চলে যায়। আর ফিরে আসেনি এই দম্পতি। কয়েকদিন পর ছেলে জহিরুল হক (জোবাঈদা ইয়াছমিনের ছোটভাই) বোন জামাতার বাড়ি চট্টগ্রাম চলে যায়। আরও কিছুদিন পর মেয়ে জোবাঈদা ইয়াছমিনের সন্তান দেখাশোনার কথা বলে ছেলে জহিরুল হক, তার স্ত্রী রাজিয়া বেগম ও ছোটবোন মনজিয়ারা দুজনকে চট্টগ্রামে বোন জামাতার বাড়ি নিয়ে যায়।

চট্টগ্রামে সবাই চলে যাবার পরও মাসখানেক পরিবারের সাথে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু গত সাত মাস ধরে তারা নিখোঁজ রয়েছে। তাদের কোন ধরনের খোঁজ খবর নেই। কোথায় আছে তাও জানেন না বলে কান্নাজড়ানো কন্ঠে কথাগুলো বলেছেন নিহত জোবাঈদা ইয়াছমিনের মা জান্নাত আরা। জোবাঈদার বাবা নুরুল আলম বলেছেন,’স্ত্রী সন্তান নিয়ে প্রায় ৩০ বছর পুর্বে মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর থেকে বাইশারী ইউনিয়নের যৌথখামার এলাকায় আসেন। সেই থেকে এই গ্রামেই তারা বসবাস করে আসছেন। তার ছেলে জহিরুল হক, মেয়ে জোবাঈদা ও জামাতা কামাল খুবই ধার্মিক ছিলেন। তারা এলাকায় পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তবে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারী এড়াতে গোপন আস্তানা নিয়ে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে জঙ্গিরা। তাদের সর্বশেষ কৌশল হচ্ছে মফস্বল কিংবা শহরের উপকন্ঠে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলা। বিশেষ করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায়। সীতাকুন্ডে দুই জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে পুলিশের কাছে এবং বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে।

পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, শুরুতে জেএমবির বাংলা ভাইয়ের মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের উত্থান হয়েছিল একেবারে গ্রামাঞ্চলে। সেখানে প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার পর ঢাকা চট্টগ্রামের বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলতে শুরু করে। সেখানে পুলিশের অভিযানে টিকতে না পেরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের মতো বড় শহরে আস্তানা গড়ে তুলে। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিদের আর মুল শহরে আস্তানা গড়ে তুলতে দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম।

এখন তারা মহাসড়কের পাশে মফস্বল কিংবা শহরের উপকন্ঠে বেছে নিচ্ছে। এটা তাদের ভিন্ন একটা কৌশল হতে পারে। হয়ত পুলিশের নজরদারী এডাতে ব্যস্ততম স্থান থেকে একটু দুরে আসা অথবা মহাসড়কে নাশকতার টার্গেট নিয়ে তারা সেখানে অবস্থান নিচ্ছে। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর উপকন্ঠ হিসেবে পরিচিত উত্তর কাট্টলীতে একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় র‌্যাব। সেখান থেকে পাঁচজনকে আটক করা হয়।এর পর গত ৮ মার্চ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরস্বরাই পৌরসভায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। ৭ মার্চ রাতে জঙ্গি তথ্যের ভিত্তিতে মিরসরাইতে আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। একইভাবে তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই পটিয়ায় অভিযান চালানো হয়।

এর পর ১৫ মার্চ আবারও ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুন্ড পৌরসভায় দুটি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেল। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশ্লেষন অনুযায়ী, মফস্বল কিংবা শহরের উপকন্ঠ ছাড়াও জঙ্গিদের আরেকটি কৌশল সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে। সেটি হল সংখ্যালঘুদের বসতি যেসব এলাকায় বেশি সেখানে আস্তানা গড়ে তোলা। বিষয়টি ’অ্যালামিং’ বলছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা। জঙ্গিরা নিয়মিত অবস্থান পাল্টাচ্ছে। আস্তানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা কৌশল নিচ্ছে। মাইনোরিটি এরিয়ায় আস্তানা গড়ে তোলা তাদের একটা কৌশল হতে পারে বলে জানান এসপি। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি সাখাওয়াত হোসেন বলেন,’ সাধারন মাইনোরিটি যেসব এলাকায় বেশি, সেখানে জঙ্গি আস্তানা করলে সন্দেহ কম হবে। এর মাঝে নাশকতা ঘটানো তাদের জন্য সহজ হবে। এটাই সম্ভবত তাদের কৌশল।

১৫ মার্চ সীতাকুন্ডের ৭ নম্বর পশ্চিম আমিরাবাদ ওয়ার্ডের নামারবাজার এলাকায় যেখানে প্রথম জঙ্গি আস্তানা পাওয়া গেছে কুঠির নামে একটি ভবন থেকে। বাড়ির মালিক সুভাষ চন্দ্র দাশ নামে এক ব্যবসায়ী। ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুদুল আলম বলেন,’ আমাদের এলাকায় মাইনরিটি মেজরিটি ফিফটি ফিফটি। তবে যেখানে সাধন কুঠিরের আশপাশের পুরো এলাকায় হিন্দু অধ্যষিত। সাধন কুঠিরের প্রায় সব ভাড়াটিয়া হিন্দু। এখানে এসে জঙ্গিদের আস্তানা করার বিষয়টি আমাদের অবাক করেছে।

৫ নম্বর দক্ষিণ মহাদেবপুর ওয়ার্ডের প্রেমতলায় যে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে সেই ছায়ানীড় ভবনের আশপাশের ৭০ ভাগ অধিবাসীই হিন্দু বলে জানান স্থানীয় কাউন্সিলর শফিকুল আলম চৌধুরী। ওই এলাকায় ২২টি হিন্দুদের মন্দির আছে। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় হিন্দুদের তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ ধাম প্রেমতলা থেকে ৫-৭ কিলোমিটার দুরে। এখানে আমরা দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান সবাই শান্তিপুর্নভাবে সহাবস্থান করছি। এখানে এসে জঙ্গি আস্তানা করা আমার কাছে মনে হয় সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতি নস্যাৎ করার একটা কৌশল।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.