‘৮০ ভাগ রাজনীতিবিদই দুর্নীতিপ্রবণ’

0

সিটিনিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ রাজনীতিবিদই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বা দুর্নীতি করার মানসিকতা আছে। এসব রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে শুধুমাত্র অবৈধ টাকা ও সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে। এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান ততটা ভাল হবে না। আধুনিক বিশ্বে দেশকে শীর্ষ অবস্থানে নিতে চাইলে দরকার সৎ ও ডায়নামিক লিডারশিপ।

সাংবাদিক আব্দুল জাব্বার খানের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় এমনটিই বললেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।

এক প্রশ্নের জবাবে এ আইনজীবী নেতা বলেন, ‘আমি মনে করি যারা রাজনীতি করবে, তারা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে। রাজনীতিটা সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না। এটাকে আমাদের সমাজ সেবার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিবিদদের এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হিসেবে একটানা পাঁচবার নির্বাচিত হওয়ার পেছনে কোন বিষয়টি কাজ করেছে বলে আপনি মনে করেন?

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন: আমি মনে করি এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনও ক্রেডিট নাই। টানা বিজয় অর্জনে সব কৃতিত্ব আমার আইনজীবী ভাই-বোনদের। তারা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন, ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন।

তবে আমার বিশ্বাস আমার সততাই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পেছনে কাজ করেছে। আমি বলব শুধুমাত্র বারের নেতা হিসেবে নয়, একজন স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান হিসেবেও আপনাকে সৎ হতে হবে। মানসিকভাবে সততার বীজ আপনাকে বপন করতে হবে। মানুষকে আপনার বোঝাতে হবে আপনি তাদের আমানতের খেয়ানত করবেন না। আপনি যদি সৎ হন তাহলে কাজ না করলেও আপনি জনগণের সমর্থন পাবেন। আপনি কারো ক্ষতির কারণ হবেন না। তাহলেই হবে। আমি সংসদ নির্বাচন করেছি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন করেছি এসব বিষয় থেকে আমার অভিজ্ঞতা হলো আপনি যদি মানুষের সম্পদের প্রতি কমিটেড থাকেন মানুষ আপনাকে নির্বাচিত করবেই।

দুর্নীতির ‍রূপ বর্তমানে এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের ধারণা একজন জনপ্রতিনিধি, মেম্বার, চেয়ারম্যানেরা অন্যের সম্পদ ভোগ করবে এটাই যেন স্বাভাবিক ঘটনা। দুর্নীতির সঙ্গ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি চেষ্টা করেছি এটা থেকে বের হয়ে আসতে। হয়ত এ কারণেই আমার জয়ের ধারাবাহিকতা আছে। অবৈধ টাকা আমার পরিবারের জন্য হারাম এটাই আমি বিশ্বাস করি। শুধু তাই নয় দুর্নীতির কোনও টাকা আমার সংসারের খরচ যাতে না হয় সেটাই প্রার্থনা করি। এটা আমরা ছোট বেলা থেকেই পালন করে আসছি আশা করি ভবিষ্যতে সে পথে অটুট থাকবো ইনশাল্লাহ।

আপনি নির্বাচিত হওয়ার পর আইনজীবীদের স্বার্থে কি কি কাজ করেছেন?

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন: প্রথমে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেই আমি বারের দুর্নীতি ও অপচয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। কয়েক বছর চেষ্টা করেছি বার থেকে দুর্নীতি নামক অপনামটি দূরে রাখতে। আমি যখন প্রথম ২০১৩-১৪ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন আইনজীবী সমিতির ফান্ডে ছিল ৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। চার বছরে আমি সেটা বৃদ্ধি করেছি প্রায় চারগুণ। যা সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে হয়নি। বারের বর্তমান ফান্ড আছে প্রায় ৪২ কোটি টাকা। এছাড়া আইনজীবীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি বহুতল ভবন। আরেকটির নির্মাণ কাজ চলছে। অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো আইনজীবীদের জন্য একটি অস্থায়ী ক্লাব করেছি। সেখানে রয়েছে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা আলাদা ব্যায়ামাগার, চাইল্ডকেয়ারসহ খেলাধুলার ব্যবস্থা। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের জন্য ভিন্ন একটি প্রভিডেন্ট ফান্ডও করা হয়েছে।

আইনজীবীদের জন্য জায়গা সংকট বরাবরই আছে। আমরা চেষ্টা করেছি সেটা দূর করার জন্য । সুপ্রিম কোর্টে অনুমতি পাওয়া সকল আইনজীবীদের জন্য রুম বরাদ্দ করা সম্ভব না হলেও তার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে জায়গা সংকটের জন্য আপাতত আইনজীবীরা একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করে নিচ্ছেন।

বিচার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক বর্তমানে সেটি বজায় আছে কি না?

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন: বিচার বিভাগ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বার এবং বেঞ্চের সমন্বয় অবশ্যই দরকার। অবশ্যই এ দু’য়ের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা উচিত। সেটি আছে বলেই বিচার কাজ সুষ্ঠুভাবে চলছে। তবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না সেটি কিন্তু আমাদের প্রধান বিচারপতিও বলেছেন। নিম্ন আদালতও পারছে না।

আর উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে সেটিও হচ্ছে না। এ কারণেই প্রধান বিচারপতি বলেছেন বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত।

বারের আগামী নির্বাচনে একই পদে আবারও অংশ নেবেন কিনা?

মাহবুব উদ্দিন খোকন: এটাতো বলতে পারি না। আগে নির্বাচন আসুক। তবে দল যদি বিবেচনা করে তাহলে করবো। না চাইলে করবো না।
আপনার আইন পেশা শুরুর গল্প জানতে চাই-

মাহবুব উদ্দিন খোকন: আমি ব্যারিস্টারি পাস করে আসার পরে এক মাসের মধ্যে এনরোল (আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি) হয়ে যাই। পরে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের চেম্বারে কাজ শুরু করি। দীর্ঘ দিন সেখানে কাজ করেছি। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। আমি তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

১৯৯৩ সালে আমি ব্যারিস্টারি পাস করে ১৯৯৪ সাল থেকে মামলা নিয়ে কাজ শুরু করি। আমার প্রথম কাজ রংপুরের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফার মামলা দিয়ে। তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল সে মামলায় জামিনের জন্য আমি নিম্ন আদালত থেকে রায় পাই।

উল্লেখযোগ্য অনেক মামলাই আমি করেছি। তবে তার মধ্যে একটি মামলার ঘটনাই আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। সেটি ছিল রাতে কোর্ট বসিয়ে ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক বাহাউদ্দীন সাহেবের আগাম জামিন নেয়া। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছিল। বিচারপতি নুরুল ইসলাম ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন এর আদালতে বিকেলের দিকে মামলাটি শুনানি হয়। তবে সিনিয়র বিচারপতি নুরুল ইসলাম তাকে জামিন দেন এবং মমতাজ উদ্দিন দ্বিমত পোষণ করেন। এই পরিস্থিতিতে কি করবো। এদিকে কোর্ট অঙ্গনের বাহিরে আইন শৃংখলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করার জন্য অপেক্ষা করছে। ভেতরে গোয়েন্দা বাহিনীও রয়েছে। এ অবস্থায় আমরা তখন তাকে কি করবো, যেহেতু তিনি জামিন পাননি তাই তিনি গ্রেফতার হতে পারেন সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরে তাকে বারের একটি রুমে নিয়ে লুকিয়ে রাখি। এরপর দ্বিমত হওয়া রায়টি নিয়ে চলে যাই তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল সাহেবের বাসায়। বাসায় গিয়ে দেখি তিনি নারায়ণগঞ্জে মিলাদে গেছেন। এরপর প্রধান বিচারপতি বাসায় ফেরা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। তিনি বাসায় ফিরলে আমরা তার কাছে বিষয়টি বলি। তখন রাত ৮ টা। উনি আবার বিষয়টি শুনানির জন্য তৃতীয় বেঞ্চ হিসেবে তখনকার সময়ে চেম্বার জজ এবিএম রুহুল আমীন (যিনি পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন) তাকে বললেন। ওই সময় বিচারপতি রুহুল আমীন সাহেবের বাসা ছিল উত্তরায়। তিনি বললেন তিনি বাসায় বসবেন। কিন্তু সমস্যা ছিল আসামিকে তো তার বাসায় নেয়া সম্ভব ছিল না। কেননা কোর্টের বাহিরে আইন শৃংখলা বাহিনী অপেক্ষা করছিল বাহাউদ্দীন সাহেবকে গ্রেফতারের জন্য। এ অবস্থায় বিচারপতি কোর্টে আসতে রাজি হলেন। তখন বারের জায়গা খালি করে গেট বন্ধ করে আইনজীবীরা গার্ড দিয়ে তাকে কোর্টে নিয়ে যাই। রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় শুনানি শুরু হয়। তখনও সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে সাংবাদিক, আইনজীবীসহ শত শত মানুষের ভীড়। কৌতুহলী হয়ে সবাই অপেক্ষা করছিল কি হয়। কেননা মধ্য রাতে কোর্ট বসাটাও ছিল একটি ভিন্ন বিষয়। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল। এ মামলায় আমি ফাইলিং ল’ইয়ার ছিলাম।

[ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার সোনাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, মাতার নাম বেগম রওশন আরা। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ভাই-বোনরা সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত।

ব্যারিস্টার খোকন নোয়াখালীর গোপালপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যের ওয়েলস থেকে এলএলবি (অনার্স) পাস করেন। বিশ্ববিখ্যাত লিংকনস-ইন থেকে ১৯৯৩ সালে ব্যারিস্টার এট ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। ব্যারিস্টার খোকন ১৯৯৪ সাল থেকে আইন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি টাঙ্গাইলের মেয়ে আতিয়া মাহবুব এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালী-১ আসন (চাটখিল-সোনাইমুড়ি) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তথ্যসুত্র : ব্রেকিংনিউজ

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.