দেশের ভূখন্ডে গুলি পড়লে পাল্টা জবাব: বিজিবি মহাপরিচালক

0

শহিদুল ইসলাম, উখিয়া ::  আমরা বীরের জাতি, স্বাধীন দেশের ভূখন্ডে একটি গুলি পড়লে পাল্টা জবাব দেওয়া হবে। আমরা পরিপূর্ণ ভাবে যেকোন সমস্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছি। অতিরিক্ত ১৫ হাজার বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

রোববার বিকেল ৪ টায় সীমান্ত এলাকা ঘুমধুম বিজিবি ক্যাম্প পরিদর্শন করে বিজিবি সদস্যদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন প্রেস ব্রিফিং কালে সাংবাদিকদের উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, চট্টগ্রামের রিজিওনাল কমান্ডার কর্ণেল আলিফ, কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার আনোয়ারুল আজিম, বান্দরবান জেলা প্রশাসক দীলিপ কুমার বণিক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান, ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল মঞ্জুরুল হাসান খান, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম সরওয়ার কামাল, ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ।

সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৯৬ জনে দাঁড়িয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৮২ জন সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম আর ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা পুলিশ পোস্টে হামলা ও একটি সেনাঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে এ সংঘর্ষের  সূত্রপাত হয়।

রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং তাদের নাগরিকত্ব প্রদানে জাতিসংঘের সাবেক মহা-সচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন একটি প্যানেলের আহ্বানের কয়েক ঘণ্টা পরই এ হামলার ঘটনা ঘটে।

আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (এআরএসএ) এক টুইট বার্তায় হামলার দায় স্বীকার করেছেন। মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগ এনে এআরএসএ জানায়, তারা ২৫টির বেশি এলাকায় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

সংগঠনটির দাবি, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় রাথেতুয়াং শহর এলাকা গত দুই সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ। সেখানে রোহিঙ্গারা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন। মংডুতে তারা যখন একই কাজ করতে যাচ্ছিল, তখন বার্মিজ উপনিবেশিক বাহিনীকে হটাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছি।

এরপর শুক্রবার ও শনিবার রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মাওন তাও, বুথিডাং ও রাথেডংসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অভিযান চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

এ সময় তারা ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেক এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে রোহিঙ্গা যোদ্ধারা। এখনও বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা আটক হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা।

অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের ঘুমধুম, তুমব্র“, রহমতের বিল, জলপাইতলী, ধামনখালী, কলাবাগান, তুমব্র“ উত্তর পাড়া, তুমব্র“ পশ্চিম পাড়ায় অবস্থান নিয়েছেন। সেখানেও তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ বিজিপি।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছেন, সীমান্তে হাজারো রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। তবে বিজিবি সতর্ক থাকায় তারা প্রবেশ করতে পারছেন না।

শনিবার দুপুরের পরে সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের ওপর মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ বিজিপি গুলি চালালে এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাদের আর্তনাদের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। গতকাল রবিবার দুপুর দেড় টার সময় তুমব্র“ কোলাল পাড়া হয়ে ঢেকুবনিয়া সীমান্তে মিয়ানমারের হেলিকেপ্টার চক্কর দেয়।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক মঞ্জুরুল হাসান খান জানিয়েছেন, তিন হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নাফ নদীর ওপারে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছেন। গত বছরের অক্টোবরে একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালায়।

তারা গ্রামের পর গ্রাম ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংগঠন দাবি করে, সেনারা রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণও করেছিল। সে সময়ে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

তারা কক্সবাজারের কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফ মুছনি, লেদা সহ বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। নতুন করে সংঘর্ষের পরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন। তাদের অনেকেই আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

গতকাল মিয়ানমার মংডুর কেফায়ত উল্লাহ জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হুরটেইল কাইল্লা ভাঙ্গা গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। শত শত লোকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। মেয়েদের নিয়ে গেছে নির্জন স্থানে।

গতকাল রোববার মিয়ানমার ঢেকিবুনিয়া তুমব্র“ থেকে এসে এপারের ঘুমধুম এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে ২ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নরনারী শিশু।

টেকনাফের উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করা কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নুর জাহান (৫০), রহিমা খাতুন (৬২), বেগম বাহার (৫৫) সহ ২৫ জনের একটি দল গতকাল রোববার ভোর সকালে তারা মিয়ানমার ঢেকুবিনয়ার কুটবনিয়া থেকে পায়ে হেটে এদেশে ঢুকে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করে।

তারা জানান, গত ক’দিন ধরে ওখানকার সামরিক জান্তারা ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে এলাকাগুলো।

মিয়ানমারের ঢেকুবিনিয়া মিয়া পাড়া থেকে পালিয়ে আসা মৃত হামিদুর রহমানের ছেলে বাদশা মিয়া (৪৫) তার স্ত্রী তৈয়বা বেগম এর সাথে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হলে তারা জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যচার সহ্য করতে না পেরে ঐ গ্রামের ৪০ টি পরিবার ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় গতকাল ভোর রাতে আশ্রয় নিয়েছে।

তাদেরকে বিজিবি সদস্যরা আটকে দিয়েছে। তাদের জীবনে কি হবে তারাও জানেনা।

ঢেকুবনিয়া ফকিরা পাড়া গ্রামের শত বছর বয়সী বদিউর রহমান ও ৭৫ বছর বয়সের তার স্ত্রী মোস্তাফা খাতুন বলেন, গত শনিবার জুহুরের নামাজের অযু করতে গেলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার পাশের ঘরে তান্ডব চালিয়ে মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়।

ঘরটি জ্বালিয়ে দেয় বলে জানান। অতি কষ্ট করে কোন রকম প্রাণের ভয়ে জলপাইতলী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছি। এদিকে, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া ও তুমব্র“ গ্রামে রোববার সকাল থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ হয়েছে।

গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছে সীমান্ত এলাকা। ওই এলাকার মিয়ানমার সীমান্তে পাহাড়ে শত শত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

মূলত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপি কৌশলে এসব রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার কৌশল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ । এতে করে আতংকে রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত জনপদের মানুষও।

এর আগে শনিবার দুপুর দেড়টায় ও বিকাশ ৪ টায় ঘুমধুম সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের ভূখন্ডে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনা যায়। শত শত রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে ‘নোম্যানস ল্যান্ডে’ অবস্থান নেওয়ায় মিয়ানমার পক্ষ আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

শনিবার বেলা ১১টার দিকে সীমান্ত-সংলগ্ন তুমব্র“ বাজারের কাছাকাছি এলাকায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এক দফা গুলি ছুড়েছে। সীমান্ত পরিদর্শনে যাওয়া বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মফিদুল আলম এ কথা জানান।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কোনো মর্টার শেল পড়েছে কি না, খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তবে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেছে এবং ঘুমধুম সীমান্তে এখন ২ হাজারের অধিক নারী-শিশু জড়ো হয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ আরো জানিয়েছেন, শনিবার বিকেল চারটার দিকে ঘুমধুম সীমান্তে ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া বাজার ও উত্তর ঢেঁকিবনিয়া এলাকায় প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়। গোলাগুলির সময় ঢেঁকিবনিয়ার দিক থেকে শত শত রোহিঙ্গা নারী-শিশু সীমান্তের দিকে চলে আসতে থাকে।

রোহিঙ্গারা প্রথমে ঘুমধুম সীমান্ত চৌকি-সংলগ্ন প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের মৈত্রী সেতু দিয়ে বাংলাদেশ ভূখন্ডে ঢুকার চেষ্টা করলে বিজিবি বাধা দেয়। পরে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ঢুকার চেষ্টা করে।

সীমান্তে জড়ো হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের আতঙ্কিত করতে বিজিপি সকালে গুলি ছুড়–ছে। সীমান্ত পরিদর্শনে যাওয়া ম্যাজিষ্ট্রেট মফিদুল আলম বলেন, বিজিপির ছোড়া তিনটি গুলি তুমব্র“ বাজারে এসে পড়েছে। তবে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।

বিজিবির ঘুমধুম সীমান্ত চৌকির অধিনায়ক নায়েব সুবেদার রফিকুল ইসলাম বলেন, হাজারো রোহিঙ্গা সীমান্তে জড়ো হয়ে রয়েছে।

বিজিবি কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার লে.কর্নেল মো. আনোয়ারুল আজিম বলেন, ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে কিছু সমস্যা হওয়ায় কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্তে জড়ো হয়েছে। কিন্তু কাউকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

সীমান্তে আরও জনবল বাড়ানো হয়েছে এবং সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.