চট্টগ্রামে বিএনপির দু:সময়ের কান্ডারী নোমানের কি হবে ?

0

জুবায়ের সিদ্দিকী : বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির বর্তমান অবস্থা শোচনীয়। তার উপর নেতাদের দ্বন্দ্বে তৃনমুলে দলটির সাংগঠনিক অবস্থাও অনেকটাই এলোমেলো। মতবিরোধের কারনে জেলা পর্যায়ে কেউ কারও নেতৃত্ব মানছেন না। তৃণমুল থেকে কেন্দ্রে প্রতিনিয়ত অভিযোগ আসছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তৃণমূলে দল গোছানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড।

দলটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, তৃণমুলে দল পুনর্গঠনের পাশাপাশি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দল গোছানো হচ্ছে। একই সঙ্গে ২০ দলীয় জোটসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ইস্যুভিত্ত্বিক আন্দোলন করারও লক্ষ্য ঠিক করা হচ্ছে। কোরবানীর ঈদের এক দুই সপ্তাহ পর থেকে সারাদেশে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি পুন:গঠনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দলের একাধিক নেতা।
ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউশন প্রাঙ্গনে ১৯ মার্চ বিএনপির ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের সাড়ে চার মাসের মাথায় ৬ আগষ্ট ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির ১৭ জন, ৭৩ সদস্যের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিল ও ৫০২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ জাতীয় নির্বাহী কমিটির নাম ঘোষনা করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর। কতিপয় নেতার স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয় কমিটিতে স্থান পাওয়ায় দলে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, বাইরেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাদের অনেকে কমিটিতে স্থান না পাওয়ায় ক্ষোভ দেখা যায়। আবদুল্লাহ আল নোমানকে দলের নীতিনির্ধারনী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য না করায় চট্টগ্রামে তার অনুসারীরা কমিটি ঘোষনার পর থেকে বিক্ষোভ করে আসছে। তারা গণ পদত্যাগের ঘোষনাও দেন।

এসব বিষয় নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে ১৮ আগষ্ট স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। তাতে তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোর পর পর্যায়ক্রমে সরকার বিরোধী আন্দোলন কারার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে বিএনপির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেই ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্টিত হয়। এরপর বারবার তৃণমুল পর্যায়ে দল গোছানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেও তা শেষ হয়নি। নির্বাচনে না গিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করলেও তাতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। তৃণমুলে দলের সাংগঠনিক অবস্থা ভাল বলে কর্মসুচী দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলেই অনেকে মনে করেন।
জানা গেছে, সারাদেশে বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার অধিকাংশ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে পড়েছে। কাউন্সিলের আগে গঠিত মাত্র ৯টি জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ১৫ জেলার পুর্ণাঙ্গ কমিটি আছে। দলটির ১১ অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের সবগুলো পুরনো কমিটি নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে যুবদল ৮ বছর, কৃষক দল ১৯ বছর, ছাত্রদল ৩ বছর, মহিলা দল ৫ বছর, স্বেচ্ছাসেবক দল ৭ বছর, মৎস্যজীবি দল ৬ বছর ও ওলামা দল ১২ বছরের পুরনো। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অনেক যোগ্য নেতা নির্বাহী কমিটিতে স্থান পায়নি।

বিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, অধিকাংশ জেলায় মেয়াদোত্তীর্ন কমিটি থাকায় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারন করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি জেলায় আহবায়ক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। এ কমিটি গঠনে পদ বাণিজ্য নিয়েও বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।
তারা বলেন, তৃণমূল নেতারা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছাড়া কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদেরও বিশ্বাস করতে চান না। তাই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাজনৈতিক দলের মূল ভিত্ত্বি হচ্ছে তৃণমূল সংগঠন। তৃণমূল পর্যায় থেকে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে গোছানোর প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা রয়েছে। এসব মামলায় অন্তত ৫ লাখের বেশি নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়েছে। এসব বাধা বিপত্তির মধ্যেও বড় দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকে। আমরা মনে করি, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগনের প্রতিনিধিত্ব সরকার এলে দেশে গনতন্ত্র ফিরে আসবে। এক নেতার এক নীতি অনুসরন করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে যারা পদ পেয়েছেন তাদের জেলা কমিটিতে সভাপতি, সাধারন সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক পদের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে বিএনপি হাইকমান্ড নির্দেশ দিয়েছে। যারা নির্বাহী কমিটিতে স্থান পাননি তারা এইসব পদে দায়িত্ব পাবেন। এদিকে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরাম জাতীয় কমিটিতে আব্দুল্লাহ আল নোমানের জায়গা না হওয়াতে হতাশ ক্ষুদ্ধ হয়েছেন চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা। কমিটি ঘোষনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও সমালোচনার ঝড় তুলেছে তারা।
নেতাকর্মীরা মনে করেন, আব্দুল্লাহ আল নোমান দলের আন্দোলন সংগ্রামে সবসময় নিবেদিত ছিলেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর বিএনপির রাজনীতির সাথে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি। কিন্তু দল তার এ পরিশ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি।
আবদুল্লাহ আল নোমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত নগর বিএনপির সাবেক যুগ্ন আহবায়ক এডভোকেট আবদুস সাত্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে নোমান ভাইয়ের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। চট্টগ্রামে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় এই নোমান ভাই বিএনপির ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করেছিলেন। দলের প্রতিটা দু:সময়ে তিনি পাশে ছিলেন। আব্দুল্লাহ আল নোমানকে মূল্যায়ন করা উচিত বলে মনে করেন নগর বিএনপির নবনির্বাচিত সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন।
তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে নোমান ভাইয়ের যথেষ্ট অবদান আছে। উনার ষ্ট্যান্ডিং কমিটিতে থাকা উচিত। চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্রদলের বামধারার ছাত্ররাজনীতি করে কারাভোগ করেছেন আব্দুল্লাহ আল নোমান। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৯ই ডিসেম্বর তার বিয়ের পরদিন ছিল ন্যাপের প্রথম কংগ্রেস। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই তিনি চট্টগ্রাম থেকে ছুটে গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে।

সে কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি ও বর্তমান বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সে কমিটির প্রচার সম্পাদক ও বিএনপির বহিস্কৃত প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূইয়া সে কমিটির কৃষি সম্পাদক ছিলেন। জিয়াউর রহমানের সময়ে বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর তিনিই মনোনীত হয়েছিলেন জাতীয় শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি। এরপর নানা উত্থান পতনেও তিনি এ দল ছেড়ে যাননি। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে কারাভোগ করেছেন। দলের চরম সংকটের সময়ও তিনি খালেদা জিয়াকে ছেড়ে জাননি।
চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি জায়েদ বিন রশিদ বলেন, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানের মূল্যায়ন না হলে রাজনীতিতে কোন মেধাবী ও যোগ্য নেতারা আসবে না। চট্টগ্রামের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়ে রেখেছেন তিনি নেতাকর্মীদের। আমরা চাই তাঁকে অবিলম্বে স্থায়ী পরিষদে সম্মানজনক পদ দেয়া হোক।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এ. এম নাজিম উদ্দিন বলেন, নোমান ভাইকে দেখে অনেকে রাজনীতিতে এসেছে। তার এমন চুপচাপ থাকাটা কিছুতেই মানা যায় না। কারণ তিনি রাজনীতিবিদ।
জানা গেছে, জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের চার মাস ১৬ দিল পর পুর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা দেয় বিএনপি। ৫০২ সদস্যের এই কমিটিতে চট্টগ্রামের ২৫ জন স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামে একই পরিবারের সদস্য হিসেবে মীর মো: নাছির উদ্দিন ও তার ছেলে মীর হেলালের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও আলাদা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মৃত্যুদন্ড হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে সদস্য করায় সাকা পরিবারের রাজনীতিতে প্রাণ ফিরে এসেছে। ৭৩ সদস্য বিশিষ্ট চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে সদস্য হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে যারা স্থান পেয়েছেন, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, গোলাম আকবর খোন্দকার, রোজি কবির এবং এম. ফজলুল হক।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.