লাশের মিছিল ও পরিবহন আইনের খসড়া

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ ‘তুমি যদি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ’। আমাদের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কয়েকদিন আগেও সবাই হতাশ ছিল। এই প্রজন্ম শুধু ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে পড়ে থাকে, বাস্তবতা বোঝে না। দেশের কোন কিছু নিয়ে তাদের চিন্তা ভাবনা নেই। কিন্তু না, দেখা গেল- কিশোররা শিকল ভাঙ্গার গান গাইতে শুরু করেছে। দুজন কিশোর শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবীতে তারা জেগে উঠেছে। সারা বাংলাদেশের পরিবহন খাতে যে পচন ধরেছে, কিশোররা সেখানে মলম না লাগিয়ে সমুলে উৎপাটন করতে চেয়েছে। ঘুনে ধরা এ সমাজকে পরিবর্তন করতে তারা গাইছে ঘুম ভাঙ্গার গান।

দেশের সর্বত্র ট্রাফিক আইন না মানতে মানতে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল-আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম, ট্রাফিক আইন মানার কথা। কিশোর তরুনরা চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছে আইন সবার জন্য সমান। এমন কোনদিন বাদ নেই, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে না। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামে না-স্বজন হারানোর কান্না শেষ হয় না। প্রতিদিন কোন না কোন মায়ের বুক খালি হয়। আমরা শুধু দেখি আর হা-হুতাশ করি। অপেক্ষা করি কবে কার পালা আসবে। কিশোররা ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করেছে। বলেছে এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। নিরাপদ সড়কের দাবীতে এ আন্দোলন ছিল বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে হিংসামুক্ত আন্দোলন।

এই কিশোররা জানে, ভয় পেলেই সব শেষ। পোকায় খাওয়া সমাজকে, ঘুনেধরা দেশকে তারাই পাল্টাতে পারে। প্রতিবাদ করতে জানে, তারা মানুষকে ভালবাসতে জানে। প্রতিটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হল সে কোথাও হারতে চায় না। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে হেরে গেলে মানুষ খুব গর্ববোধ করে। একটি হল, পিতা হিসাবে সন্তানের যোগ্যতার কাছে, এবং অন্যটি হল শিক্ষক হিসাবে শিক্ষার্থীর মেধা ও মননশীলতার কাছে। নিরাপদ সড়কের দাবীতে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের রাজপথে আন্দোলন শুধু দেশেই নয়, বর্হিবিশ্বেও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবী নতুন নয়। নিরাপদ সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার দায়িত্বে নিয়োজিতরা এ ব্যাপারে কোন কার্যকর ভুমিকা পালন করতে পারেনি। পরিবহন খাতে ছিল অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ভরা।

এ ব্যাপারে যে আইন রয়েছে, তাও ছিল অনেকটা হাস্যকর। এমন পরিস্থিতিতে একটি দুর্ঘটনার সুত্র ধরে কোমলমতি ছাত্ররা যখন প্রতিবাদী হয়ে উঠল, তাদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেনী ও পেশার মানুষ। শিক্ষার্থীরা যা করেছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আইনশৃঙ্খলার রক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের অবস্থান মাঝে মধ্যে আমাদের বিব্রত করেছে বটে, তবে তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক শিক্ষনীয় বিষয়ও রয়েছে।

দেশে কত আন্দোলই না হল, কিন্তু কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিস্ময়কর আন্দোলন বাংলাদেশে এই প্রথম। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে পদ্মতিতে আন্দোলন করেছে তা নি:সন্দেহে অহিংস আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা যেভাবে রাগ, ক্ষোভ কিংবা আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে আন্দোলন করেছে, তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। আমরা মনে করি বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন এ কার্যত জনদাবীর প্রতিফলন ঘটেনি। প্রত্যাশা ছিল বিদ্যমান আইনের চেয়ে প্রস্তাবিত আইনটি অনেক বেশি কঠোর হবে।

কিন্তু দৃশ্যত তা খুব কঠোর হয়নি। আইনের খসড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পরিমান বিধান রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য এ আইনে আগে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বা প্রানহানীর জন্য সর্বোচ্চ সাজা বা এর বেশি বছর করায় এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল সাত বছর করার। খসড়া আইনে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের কারাদন্ড করায় যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। বরং বাস মালিক শ্রমিকদের স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তবে তদন্তে কারও নিহত হওয়ার ঘটনা উদ্দেশ্যমুলক হত্যা বলে প্রমানিত হলে সেক্ষেত্রে ফৌজদারী আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধান প্রয়োগ হবে বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বস্তুত এটিও নির্ভর করে তদন্তের উপর। তদন্ত যদি সুষ্ট হয় এবং এর রিপোর্ট ও চার্জশীট যথাযথ হয় তবেই অপরাধীর যথাযথ সাজা হতে পারে। এ জন্য তদন্তকারী পুলিশকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন দেয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। আইনটির গুরুত্বপুর্ন দিক হল এতে দুর্ঘটনায় কেবল চালকের সাজার কথা বলা হয়েছে। এটা ঠিক, আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া গাড়ি চালনা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কারনেই দুর্ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে।

তবে দুর্ঘটনার জন্য চালক ছাড়াও আনফিট গাড়ি, ত্রুটিপুর্ন সড়ক বা অন্য কোন অবকাঠামো, এমনকি দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিও দায়ী হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের হাজার প্রশ্ন এসে যায়। আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একটা সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। এটাও বিআরটিএর জন্য ভয়ভীতির কারন। মাঝেমধ্যে এ ধরনের চাপ না এলে সচেতনতা বাড়ে না। সৈয়দ আবুল মকসুদ (লেখক ও গবেষক) বলেছেন, পৃথিবীর সব মানুষ যেমন একরকম নয়, সব দেশের অবস্থাও এ রকম নয়। সমাজও এক রকম নয়।

একটি উন্নত কম জনসংখ্যার দেশের গনপরিবহনে সমস্যা আর জনবহুল বাংলাদেশের গনপরিবহন সমস্যা এক রকম নয়। উন্নত দেশের রাস্তাঘাট আর আমাদের দেশের রাস্তাঘাটের অবস্থা এক নয়। বহুদিন ধরে এ খাতের সমস্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি। এই সমস্যা বহুমাত্রিক ও জটিল। অন্যদিকে সড়ক মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব সফিকুল ইসলাম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদ্যোগ ও বক্তব্য দেশবাসী শুনেছে, জেনেছে। ব্ল্যাক ষ্পটগুলো চিহ্নিত করে সওজ অধিকতর কাজ করছে। সংশ্লিষ্টদের দাবী বাস্তবায়ন করছে সরকার। নিরাপদ সড়ক চাই এবং এই দাবী দেশের সবার। সরকারও নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় এবং সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাফিক সপ্তাহে দেখা গেল, গাড়ির ফিটন্যাস ও রুট পারমিট নেই। মামলার ভয়ে সে সব গাড়ি সড়কে নেই। এ ছাড়া লাইসেন্স না থাকা চালকও পথে নামেনি। ছাত্ররা ক্লাসে ফিরেছে। ফেরেনি শৃঙ্খলা। চট্টগ্রাম নগরীতে ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেও কাগজপত্র ছাড়া চলেছে বাস, লেগুনা, টেম্পু। আইনের তোয়াক্কা না করে নাম্বারবিহীন সিএনজি চলছে শহরে ও মফস্বলে। শুধুমাত্র পুলিশের টোকেনে সিএনজি, টেম্পু, রাইডার সহ অনেক যানবাহন নগরীতে দাপিয়ে বেড়ালেও এগুলো দেখার যেন কেও নেই। জাঁতাকলে যাত্রীরা হিমশিম খাচ্ছে।

আইন মানছেন না কেউই। অবৈধ সিএনজির টোকেন দেয় পুলিশের সহযোগিতায় একটি সিন্ডিকেট। এরা অফিস খুলে বসেছে নগরীর চৌমুহনীতে। ট্রাফিক সার্জেন্ট, কনষ্টেবল প্রকাশ্যে প্রধান প্রধান সড়কে দাঁড়িয়ে অথবা সাদা পোষাকে চাঁদাবাজ নিয়োগ করে চাঁদা আদায় করছে। প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে ট্রাফিক পুলিশ। তাদের টোকেনেই আনফিট গাড়িগুলো রাস্তায় চলে। ঘটায় দুর্ঘটনা। এর প্রতিকার নেই। দেখারও কেউ নেই। সড়কে লাশের মিছিল যেন কোনমতে থামছে না।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.