শুক্লাম্বর দীঘির প্রাচীন মেলায় পূণ্যার্থীদের ভীড়
এস কফিল,চন্দনাইশ : চন্দনাইশ উপজেলার বরমার বাইজুরী গ্রামে লাখ লাখ নারী পুরুষের উপস্থিতি যথাযথ মর্যদায় শেষ হলো গতকাল ১৪ জানুয়ারী প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শুক্লাম্বর দীঘির স্নান উৎসব। উপজেলার বরমার সনাতন সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান শ্রী শ্রী শুক্লাম্বর দীঘি ও তৎসংলগ্ন প্রায় ১৫/২০ একর বিশাল এলাকা ও ৩ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে এ মেলা বসে। মেলা একদিন হলেও আগের দিন বিকেল হতে পূণ্যার্থী, তীর্থযাত্রী, দোকানী ও পূজারীদের আগমন ঘটে। সকালে দেখা যায়, মেলাঙ্গনে উপড়েপড়া মানুষের ভীড় জমে। কোথাও তীল ধারনের ঠাঁই ছিল না।
সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান হলেও মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদেরও সমাবেশ ঘটে। তাদেরও সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। মেলায় নাগরদোলাসহ বিভিন্ন ধরনের রাইড প্লাস্টিক, পাইবার, এলুমিনিয়াম, লৌহ, পিতল ও মাটির তৈরি জিনিসপত্র, গ্রামাঞ্চলের তৈরি হস্ত ও কুঠিরশিল্প সামগ্রী, শাকসবজি, মাছ-মাংস, বইপত্র, ধর্মীয় প্রকাশনা, শো-পিচ, স্টেশনারী, কাঠের ফার্নিসার সামগ্রী, ক্রোকারিজ, উলের তৈরি ঝাড়, কসমেটিকস সামগ্রী ইত্যাদির বিকিকিনি চলে ধুমধামের সাথে।
প্রতি বছরের মত এবারও পৌষ সংক্রান্তির মেলায় পার্শ্ববতী ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন মানত নিয়ে এ পীঠমন্দিরে আসে। মেলায় যারা বিভিন্ন মনোবাসনা নিয়ে আসেন তা পূর্ণ হয় বলে তাদের বিশ্বাস। তাছাড়া সারা বছর প্রতিদিন বিভিন্ন মানস নিয়ে পূর্ণের লক্ষ্যে দীঘিতে দুধ উৎসর্গ, ছাগল ও কবুতর, ফল-ফলাদি ইত্যাদি দেয় বলে জানা যায়। তাদের মতে দীঘির পানিতে উৎসর্গকৃত দুধ পানির সঙ্গে না মিশে তলদেশে চলে যায়। এ রকম নানা উপাখ্যান আছে দীঘিকে ঘিরে।
তাদের বিশ্বাস, এখানে দুধ, ছাগল, কবুতর এমনকি সোনার অলংকার উৎসর্গ করলে মনের সব বাসনা পূরণ হয়। আর তাই সারা বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের নানা ধরণের মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে মানুষগুলো একই মহনায় মিলিত হওয়ায় শুক্লাম্বর দীঘি হয়ে উঠে থাকে প্রতি বছর মিলন মেলায়। এখানে দিনব্যাপী চলে উৎসব। সে সাথে প্রত্যেকে স্ব-স্ব ধ্যানে-জ্ঞানে মগ্ন থাকেন পূজা অর্চনায়। পূর্ণার্থীদের ভিড়ে এ দিনটি উৎসবমূখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এশিয়ার হিন্দুদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত শুক্লাম্বর পীঠমন্দির। শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য ভারতের নবদ্বীপ নদীয়া থেকে চন্দনাইশের বরমার বাইনজুরীতে আগমন করেছিলেন। তিনি ১১ একর জায়গায় শিবমন্দির সৃষ্টির মাধ্যমে সাধনা শুরু করেছিলেন। বছরের পর বছর ধর্মীয় সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভ করেন। তার অলৌকিকতায় শঙ্খনদী বরমা এলাকার দিকে প্রবাহিত হতে থাকলে তার মহান সাধনায় শঙ্খনদীর গতি ফিরে যায় বলে তাদের বিশ্বাস। তৎকালীন সময়ে এলাকায় নারী-পুরুষের বিবাহ অনুষ্ঠানের যাবতীয় সরঞ্জামাদি স্বর্ণ, পৌপ্য, হীরা ও মূল্যবান ধাতুর তালিকা মহাসাধক শুক্লাম্বর এর হাতে দিলে বিবাহের দিন উক্ত দীঘিতে তালিকাভুক্ত সকল মালামাল ভেসে উঠত বলেও তারা জানান।
বিবাহের দিন ঐ সমস্ত মালামাল ব্যবহার করে সাধকের নিকট ফেরত দিলে, সাধক তা দীঘিতে ফেলে দিতেন। প্রতি বছর এ দিনে শুক্লাম্বর ভট্টাচার্যের জীবন কীর্তি নিয়ে দেশ-বিদেশের লাখো মানস নিয়ে কবুতর, দুধ, ছাগল বিসর্জন ও বলী দিয়ে ধর্মীয় পূজা সম্পন্ন করেন। হাজার হাজার নারী-পুরুষ,শিশু কিশোররা উক্ত দীঘিতে স্নান করে জীবনের পাপ মোচন করে।
শুক্লাম্বর দীঘির পাড়ে শত বছরের আগের একটি বটবৃক্ষ রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত নারী-পুরুষেরা বিভিন্ন মানস করে বটের ঢালে সুতার গিট বেঁধে দিতে দেখা যায়।
সে বটবৃক্ষে শত শত কবুতর ছেড়ে দিতে দেখা যায়। তাদের ভাষায় নারী-পুরুষ একসাথে পাপ মোচনের জন্য কোন জড়তা ছাড়া স্নান করতে দেখা গেছে। হাজার হাজার দর্শনার্থীকে জমজমাট এ মেলায় বিভিন্ন মালামাল কিনতে দেখা যায়। কেউ কেউ গরু বাচ্চা দিলে প্রথম দুধ এ দীঘিতে দিয়ে থাকে। এমনকি কোন গাছে প্রথম ফল ধরলে এখানে দিয়ে থাকে বলে জানা যায়। বর্তমানে এ পীঠমন্দিরে বরমার ৪টি ব্রাহ্মণ পরিবারের প্রায় ১৫ জনের অধিক ব্রাহ্মণ সেবা করে যাচ্ছে।
মেলা চলাকালীন সময়ে ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী, থানা অফিসার ইনচার্জ ফরিদ উদ্দীন খন্দকার, মেলা কমিটির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, দীঘির উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হারাধন দেব, সাধারণ সম্পাদক নিপেন্দু দত্ত, মেলার সাধারণ সম্পাদক পরিমল মহাজন, অর্থ সম্পাদক আশীষ দেব, বরমার প্যানেল চেয়ারম্যান আবু জাফর, পূজা কমিটির নেতা অরুপ চক্রবর্তী প্রমুখ জানান, ঐতিহ্যবাহী মেলাটি সুশৃঙ্খলভাবে চন্দনাইশ থানা পুলিশ ও জেলা পুলিশসহ সকলের সহযোগিতায় সম্পন্ন করতে পেরেছে বলে জানান।