সুশাসন ছাড়া প্রবৃদ্ধি অর্জন বিতর্ক প্রসঙ্গে

0

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান:: সুশাসন ছাড়াই প্রবৃদ্ধি সম্ভব— এ ধরনের একটি আলোচনা সাম্প্রতিক সময়ে চালু হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের কিছু সমর্থক গোষ্ঠী এ ধারণাকে রীতিমতো একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাখ্যা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউও নব্বই ও তার পরবর্তী দশকের প্রবৃদ্ধির আলোচনা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে একই ধরনের একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার দিকে ঝুঁকেছেন। কিছু লেখায় এটিকে বাংলাদেশ প্যারাডক্স বা উন্নয়ন ধাঁধা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এখানে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত. নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা কতটুকু ‘সুশাসন ছাড়াই প্রবৃদ্ধি’ এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত. নব্বইয়ের দশকে সুশাসনের কোন ধারণাগুলো প্রাধান্য পাচ্ছিল এবং এ ধারণাগুলোর মূল প্রবক্তা ছিল কোন গোষ্ঠীসমূহ। রাজনৈতিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যে প্রশ্নগুলো তোলা যুক্তিযুক্ত, তা হলো নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাগুলো দেখার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছিল।

নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সুনির্দিষ্ট কয়েকটি সংজ্ঞা দিয়ে সুশাসনের ব্যাখ্যা তৈরি করেছিল। তাই আমরা দেখি, সুশাসনের আলোচনাটা নব্বইয়ের দশকেই বেশি করে শুরু হয়। আশির দশকের দিকে যদি লক্ষ করা হয় তাহলে বিষয়টি এমন নয় যে, ওই দশকে সুশাসন ছিল কিন্তু পরের দশকে ছিল না। এক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে আলোচনাটা আশির দশকে ছিল মূলত কাঠামোগত সমন্বয় বা structural adjustment। নব্বইয়ের দশকে সুশাসনের আলোচনাটা আন্তর্জাতিক মহল থেকেই এসেছে। সেখানে বাংলাদেশের কিছু বিষয় যেমন— রাজনৈতিক সংঘাত, দুর্নীতি ইত্যাদি সামনে চলে আসছিল। তাই উন্নয়নকে বোঝার জন্য সুশাসন আছে কি নেই— তখন এ আলোচনাটা খুব বেশি করে হয়।

সে সময় সুশাসনে বেশকিছু সূচকে ঘাটতি ছিল বটে, কিন্তু সুশাসনসংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইতিবাচক প্রেক্ষিত ছিল। প্রথমত মধ্য সত্তর থেকে প্রায় দেড় দশকজুড়ে আমলাতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পর নব্বইয়ের দশকে প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন হয়; এরশাদের পতন এবং ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন। এর মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির শুরু, যা প্রবৃদ্ধির জন্য বিশাল একটি ভূমিকা রেখেছে। তাই সে সময় সুশাসন ছাড়া প্রবৃদ্ধি হয়েছে বিষয়টি এভাবে বলা উচিত নয়। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি কতটা টেকসই তা নিরীক্ষা করতে সুশাসনের ঘাটতি ছিল কি ছিল না— এভাবে চিন্তা করলে চলবে না, বরং যে সূচকগুলোর মাধ্যমে প্রবৃদ্ধিটা ত্বরান্বিত হচ্ছিল, সেই সূচকগুলোর বর্তমান অবস্থা কী— তা থেকে আমরা বুঝতে পারব প্রবৃদ্ধিটা বর্তমানে টেকসই হবে কি হবে না।

ওই সময় অন্যতম বিষয় ছিল প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি। এর মধ্যে সংঘাত, সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি সবই ছিল; কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির একটা বাস্তবতা ছিল। সেখানে সত্যিকারের পালাবদলের ঘটনাও ঘটেছে। ’৯১ থেকে ’৯৬ এবং ২০০১ সালেও ভিন্ন ভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। প্রতিযোগিতার চাপ তৈরির যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তা ছিল সুশাসনের জন্য ইতিবাচক বাস্তবতা। যা অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকারীদের কার্যপরিচালনার জন্য একটি পরিসর তৈরি করে দিয়েছিল। এটি এক নম্বর।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে— এই দার্শনিক টানাপড়েনের বিষয়টি আশির দশকে মোটামুটি সমাপ্ত হয়। আমলাতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রায়ত্ত খাত দিয়েই অর্থনীতি চলবে, নাকি বাজার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্থনীতি চলবে? এক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং সমাজের অর্থনীতির নীতিবিষয়ক ডিসকোর্সগুলো আশির দশকের শেষে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মোটামুটিভাবে বাজার অর্থনীতির বিকাশ ঘটতে দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি ১৯৯১ থেকে বাজার অর্থনীতির বড় ধরনের বিকাশ ঘটতে থাকে। ব্যক্তি-উদ্যোগের ওপর আমলাতান্ত্রিক যে রাশ টেনে ধরা ছিল, তা ক্রমেই পশ্চাত্পদ হতে থাকে। ব্যক্তি খাতে নানা ধরনের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়, পোশাক খাতে ক্যাশ ইনসেনটিভ প্রদান করা হয়, বাণিজ্যে উদারীকরণও হয়। মূলত বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একটি জোরালো নীতি সমর্থন পায়। তাই যখন বলা হয়, সুশাসন ছাড়া প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এক্ষেত্রে আমি মনে করি, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি অতীতে মনোনিবেশ করি তাহলে সুশাসন ছাড়া প্রবৃদ্ধির প্রস্তাবনা অত্যন্ত খণ্ডিত একটি ব্যাখ্যা এবং এটা দিয়ে বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কিনা, তার ভালো কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সঠিক উত্তরটি হলো প্রথমত প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির প্রত্যাবর্তন হয় নব্বইয়ের দশকে, সেজন্য ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। দ্বিতীয়ত. একচেটিয়া বাজার অর্থনীতি নয়, প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতি একটা নীতি সমর্থন পায়। এ কারণে সে সময়ে ব্যাপকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

তৃতীয় লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে, ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক দলগুলো জনসমর্থন আদায়ের জন্য বেশকিছু উদ্ভাবনী নীতির সূত্রপাত করে। যেমন, শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ। প্রথমে শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, পরবর্তীতে উপবৃত্তি প্রদান কর্মসূচি। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে আমরা বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপক প্রসার লক্ষ করি। যেটি হয় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। খালেদা জিয়া এটি শুরু করেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা তার সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ে অনেক উদ্যোগী ভূমিকা নেন। তার মানে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির কারণে প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলো জনহিতকর নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহী হয় এবং তারা উদ্ভাবনী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকের প্রবৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করার জন্য যা অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের বাজার অর্থনীতি প্রতিযোগিতাভিত্তিক হলো বটে, তবে এখানে আবার সামাজিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির প্রতি ব্যাপক সমর্থন তৈরি হয় এবং তার সুস্পষ্ট সুফল আমরা কয়েকটি খাতে দেখতে পাই। যেমন, স্বাস্থ্য খাতে টিকাদান কর্মসূচিতে আমরা ব্যাপক সামাজিক প্রচারণা পদ্ধতি গ্রহণ করি। বলা যায়, সরকার ও এনজিওদের সহযোগিতামূলক কৌশলের মাধ্যমে সামাজিক সূচকগুলোয় অগ্রগতি সাধিত হয়। সরকার সহায়তা দিয়েছে, অন্যদিকে এনজিও সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তার সুফল আমরা পেয়েছি টিকাদান কর্মসূচিতে, স্যানিটেশনে, প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং নারী শিক্ষাকে আরো ত্বরান্বিত করার বিষয়ে। এনজিও ও সরকার যৌথভাবে কর্মসম্পাদনের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে।

যখন কিছু আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিশ্লেষক বলেন, নব্বইয়ের দশকে সুশাসনের ঘাটতি সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল তা কিন্তু তত্কালীন বাস্তবতার সার্বিক বিষয়টি খোলাসা করে না। উপরের যে বিষয়গুলো আমি উল্লেখ করলাম এর সবই তো সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যার মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রথমত এর নেপথ্যে কাজ করেছে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির প্রত্যাবর্তন। দ্বিতীয়ত. প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতিভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে নীতিগত অবস্থান নেয়া। তৃতীয়ত. প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মসূচি ইত্যাদি নীতি গ্রহণ। চতুর্থত. সরকার, এনজিও ও সামাজিক শক্তি মিলে সহযোগিতার কৌশলের মাধ্যমে সামাজিক সূচকে দ্রুততর অগ্রগতি সাধন। এর অন্যতম উদাহরণ হিসেবে আমি বলব, স্যানিটেশন সমস্যা সমাধান। নব্বইয়ের দশকে এ সমস্যার গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতেও একই অগ্রগতি বিদ্যমান, যা সম্পাদিত হয়েছে কয়েকটি পদ্ধতিতে। অংশগ্রহণমূলক কৌশল তো বটেই। পাশাপাশি আমাদের অগ্রগতির যে ধারণাটি, সেখানে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য নব্বইয়ের দশকে আমরা যে দক্ষতা দেখিয়েছি তা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন গন্তব্যগুলোকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারা। যেমন, স্যানিটেশন। এক্ষেত্রে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রথমে ব্যবহারিক পরিবর্তনে গুরুত্ব দেয়া হয়। খোলা জায়গার বদলে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পায়খানা ঠিক করে দেয়া হলো। এরপর উদ্ভাবনী মডেল হিসেবে নিয়ে আসা হয় রিংস্লাব। পরবর্তীতে এটিকে আরো বেশি স্বাস্থ্যসম্মত করার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তাগুলো আমরা খুব ভালোভাবে নিয়ে আসতে পেরেছি। একই সঙ্গে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারকে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীকে স্মরণ করতে হয়। আশির দশকের শেষ দিকে তিনি মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন প্রকৌশলী বাহিনী তৈরি করেন। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকের প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালক ছিল ফিডার রোডগুলো। যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কারের ফলে সমন্বিত জাতীয় অর্থনীতি ব্যবস্থা সম্ভব হয়। আশির দশকে এটি ছিল না। মূলত নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের এক একটি এলাকা ধরে এক একটি প্রকল্প নিয়ে ফিডার রোডসের মাধ্যমে খুব দ্রুত গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে মফস্বল, শহর এবং কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগগুলো তৈরি হয়। মূলত এ বিষয়গুলোর ফলে প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা ত্বরান্বিত হয়। এ ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারছি যে, নব্বইয়ের দশকে সুশাসন ছিল না অথচ প্রবৃদ্ধি হয়েছে— এ কথাটি বলার সুযোগ নেই। তাছাড়া ‘সুশাসন ছিল না তবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে’— এ কথাটা মূলত বৈশ্বিক আলোচনা থেকে এসেছে। বিষয়টি এমন নয় যে, সুশাসনের অন্য বিষয়গুলো অনুপস্থিত ছিল। বরং প্রবৃদ্ধির জন্য নিয়ামকগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

এ পর্যায়ে দেখতে হবে নব্বইয়ের দশকে প্রবৃদ্ধির যে ধারা তৈরি হলো, তা ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বর্তমানে টেকসই কিনা। যে ফ্যাক্টরগুলো প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছে, তার বর্তমান বাস্তবতা কী। আমরা দেখতে পাই, সেই নব্বইয়ের দশকে প্রথমবার প্রবৃদ্ধির উন্নতির ধারা ৫ শতাংশ উন্নীত হয়। পরের দশকে এটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬ শতাংশে। তারপর থেকে কিন্তু বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির উন্নতির ধারাটা মোটামুটি স্থবির। উল্লেখ্য, প্রবৃদ্ধি স্থবির নয়, স্থবির প্রবৃদ্ধির উন্নতির ধারা।

বর্তমানে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে কথাটা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে অনেক বির্তক রয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা এ বিতর্কগুলো আরো বেশি দেখব। তাছাড়া পরিসংখ্যান নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার যে সংকট তৈরি হচ্ছে, তা প্রবৃদ্ধি টেকসই না হওয়ার অন্যতম অনুসর্গ। একটা বিষয় হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। শাসন ব্যবস্থায় বৈধতার সংকট রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুপস্থিত হয়ে আছে। ফলে ব্যক্তি-উদ্যোগের বিকাশ প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির আবহে যেভাবে হতো, এখন তা ব্যাহত হচ্ছে। দুই. প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির বাস্তবতার ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে রয়েছি। অনেক ক্ষেত্রে একচেটিয়া বিষয় চলে এসেছে। নীতিনির্ধারণ ও অর্থনৈতিক সুযোগের বিতরণ রাজনৈতিক সমর্থক গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে। যেমন, ব্যাংকিং খাত। প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি থেকে আমরা পেছনে চলে গেছি। প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি থেকেও আমরা পেছনে সরে এসেছি। তৃতীয় যে বিষয়টি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা হলো বাজার অর্থনীতির বিষয়ে যে দার্শনিক নীতি বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল, তা থেকেও আমরা পেছনে চলে গেছি। প্রতিযোগিতামূলক থেকে ক্রনি ক্যাপিটালিজমের দিকে ধাবিত হচ্ছি। এর মানে সুবিধাভোগী ও ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট গুটিকয়েক চক্রের কাছে অর্থনীতির বিশাল বিশাল সেক্টর জিম্মি হয়ে যাচ্ছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি খাত, ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে বৃহৎ সেক্টরগুলোর দিকে যদি আমার তাকাই, তাহলে দেখি ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। যা কিনা নব্বইয়ের দশকে ছিল না। এসব কারণে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এর সঙ্গে দুর্নীতির সমস্যা যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দুর্নীতি নতুন সংস্করণে তৈরি হয়েছে। প্রবৃদ্ধির ওপর যার প্রভাব পড়ছে আরো বেশি। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করার জন্য বা টেকসই না করার নেপথ্যে এটি কাজ করছে। যেমন, অযৌক্তিক প্রকল্প ব্যয়। সব মিলিয়ে একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। অযৌক্তিক প্রকল্প ব্যয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব। অযৌক্তিক প্রকল্প ব্যয় এবং বিলম্ব হওয়ার কারণে বাজেটের আকার বাড়ছে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুফলটা আসছে না। খরচ অনেক হচ্ছে কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময়কাল কমছে না।

আরো কিছু বিষয়ের দিকে যদি লক্ষ করি তাহলে দেখি যে, আমরা এক ধরনের অনিশ্চতার মধ্যে আছি। আমরা জানি না কীভাবে এর সমাধান হবে। নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যেগুলো নব্বইয়ের দশকে ছিল না এবং এখন আরো বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে উদ্ভব হয়েছে। যেমন নগরায়ণ। নব্বইয়ের দশকের ঢাকা নগরী এবং বর্তমানের ঢাকার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য বিদ্যমান। তাছাড়া নগর সমস্যাগুলো এমন পর্যায়ে চলে চলে গেছে, যা প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে ব্যাহত করছে। যানজটের কারণে ঢাকার বর্তমান যে বাস্তবতা তার কোরো জুতসই সমাধান করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। তার ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু যান চলাচলে গতি কমে যাচ্ছে। তাই ঢাকার বর্তমান অবস্থা প্রবৃদ্ধির পথে বাধামূলক।

এর পাশাপাশি আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা উল্টোপথে হাঁটছি। তা হলো সরকার এবং এনজিওর অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কৌশল। কারণ এখন আমাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণমূলক মানসিকতা জোরালো হয়েছে, এটা নব্বইয়ের দশকে ছিল না। নিয়ন্ত্রণমূলক মানসিকতার কারণে সহযোগিতার উন্নয়ন কৌশলে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। নিয়ন্ত্রণের ধারণা ও মানসিকতার কারণে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু আমলাতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। ফলে সহযোগিতার উন্নয়ন কৌশল থেকে আমরা এখন আমলাতান্ত্রিক কৌশলের দিকে শতগুণ বেশি ঝুঁকে পড়েছি। শিক্ষা ব্যবস্থা যার বড় একটি উদাহরণ। পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন হবে, কখন হবে, পাঠ্য বিষয়ে কী অন্তর্ভুক্ত হবে— এ বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। মূলত সহযোগিতার ভিত্তিতে নয়, নিয়ন্ত্রণের ধারণার ভিত্তিতে কৌশল নির্ণীত হচ্ছে। এক্ষেত্রেও আমরা উল্টোপথে হাঁটছি। তাই প্রবৃদ্ধি টেকসই হচ্ছে না— এটাই আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। দ্বিতীয়ত. প্রবৃদ্ধি টেকসই না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে যে ফ্যাক্টরগুলো প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছিল তা এখন অনুপস্থিত।

এখন কিন্তু সুশাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা হয় না। নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সুশাসনের সুনির্দিষ্ট কিছু সংজ্ঞা নিয়ে বেশি আকৃষ্ট ছিল। এজেন্ডা ছিল। তাই সে সময় এটা নিয়ে আলোচনা ছিল। এখন তারা এটা নিয়ে সেই পর্যায়ের আলোচনা করে না। এখন হয়তো অন্য কিছু নিয়ে তারা আলোচনা শুরুতে আগ্রহী। সুতরাং সুশাসন ছিল না, তবে উন্নয়ন হয়েছে— এটা আলোচ্য বিষয় নয়, বরং যা আলোচনায় আসা উচিত তা হলো নব্বইয়ের দশকে প্রবৃদ্ধির পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক কিছু ফ্যাক্টর তৈরি হয়েছিল, বর্তমানে যেগুলো থেকে আমরা পেছনে চলে গেছি। যার ফলে যে ধরনের উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তার ঊর্ধ্বগতি স্লথ হয়ে গেছে। আমরা মোটামুটি একটি জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি।

আমরা আরো একটি বিষয় যদি লক্ষ করি তা হলো, নব্বইয়ের দশকের ঠিক পর পরই বাংলাদেশ যে উন্নয়ন অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার স্বীকৃতি ছিল। যার অন্যতম একটি উদাহরণ ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস বিশ্বের দ্রুত উদীয়মান ১১টি দেশের যে তালিকা করে বাংলাদেশ তার মধ্যে চলে এসেছিল। ওই তালিকা নিয়ে আজকাল খুব একটা আলোচনা হয় না। আমরা যদি তালিকার হিসাবটা নিই তাহলে দেখি, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ তালিকায় প্রবেশ করেছিল ঠিকই, তবে তার অবস্থান সর্বনিম্নে ছিল। মাথাপিছু আয় হিসাবে অবস্থান ছিল ১১তম। ২০১৮ সালেও কিন্তু আমরা ওই ১১তম অবস্থানেই আছি। লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাব, ২০০৪ সালের গোল্ডম্যান স্যাকসের তালিকায় আমাদের সমকক্ষ যারা ছিল, তারা অনেকে কিন্তু দ্রুততর গতিতে এগিয়ে গেছে। আমাদেরও অগ্রগতি হয়েছে, তবে বৃদ্ধির তুলনামূলক গতির দৃষ্টিকোণ থেকে আমার পিছিয়ে গেছি। আমাদের প্রবৃদ্ধিটা যে টেকসই হচ্ছে না তার নেপথ্যে এটিও আরেকটি বিষয়।

নব্বইয়ের দশকে প্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তার এক ধরনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেও ঊর্ধ্বমুখী গতির প্রশ্নে আমাদের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার নিচেই থাকছে। অর্থাৎ দ্রুত ও মানসম্মত প্রবৃদ্ধি টেকসই হচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ, যে ফ্যাক্টরগুলোর জন্য নব্বইয়ের দশকে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছিল, যেমন— প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি, প্রতিযোগিতার চাপে রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনচাহিদার প্রতি মনোযোগী হওয়া, একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতিই মূলধারায় রূপান্তরিত হওয়া এবং সরকার, এনজিও ও সামাজিক শক্তির সহযোগিতামূলক উন্নয়ন কৌশলকে গুরুত্ব দেয়া— এ ফ্যাক্টরগুলো এখন অনেকটা গৌণ হয়ে গেছে। সার্বিক বিষয়টি যদি আমরা এভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে তা অর্থবহ হয়।

লেখকসাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

চেয়ারপারসন, পিপিআরসি

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.