এনকাউন্টার ও গড ফাদারদের উপর নজরদারী

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ মাদক এখন আর কোন বিশেষ শহর বা বিশেষ শিল্প এলাকার সমস্যা নয়, এটি এখন দেশের প্রধান সমস্যা। গ্রামাঞ্চলেও ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে নানা ধরনের মাদক। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আসক্ত হয়ে পড়ছে।

সারা দেশে অভিভাবকরা আজ এক অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। অনেক জায়গায় মাদকের হাট-বাজার বসছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্কুল-কলেজের ছাত্র জীবনে ছিল অসম্ভব মেধাবী, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক মনস্ক অনেক সম্ভাবনাময় তরুন-তরুনী সর্বনাশা মাদকের ছোবলে ধ্বংসের পথে। বাবা-মা অনেক কষ্টে ছেলে মেয়েকে উচ্চশিক্ষা গ্রহনের জন্য পাঠিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেখানে সহপাঠীদের দেখাদেখিতে কৌতুহল বশত গ্রহন করছে মাদক। ব্যাচেলর জীবনে রুমমেটদের দেখাদেখিতে অনেকে হচ্ছেন মাদকাসক্ত। কেউ আবার শিক্ষা জীবন শেষে চাকরী নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে এক সময় বেকারত্বের অভিশাপ ও হতাশা থেকে গ্রহন করছে মরণঘাতক মাদক। সমাজের অনেক ধনীর দুলালরা মাদককে নিত্য সঙ্গী হিসেবে নিয়েছে।

যার পেছনে আছে সহজেই টাকা প্রাপ্তী, পারিবারিক অশান্তি ও উশৃংখল জীবনাচার। মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের সন্তানরা মাদকাসক্ত হয়ে গোটা পরিবারকে করছে অভিশপ্ত। চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার বিভিন্ন অলিগলিতে খুব সহজে পাওয়া যায় ফেন্সিডিল, হেরোইন, গাঁজা, বাংলা, হুইসকিসহ হাল আমলের আলোচিত সর্বনাশা মাদক ইয়াবা। পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে এসব মাদকের কারখানা।

সেখান থেকে অর্থলোভী ও বিবেকহীন এ দেশের চোরাকারবারীদের সিন্ডিকেটের সহায়তায় গোটা দেশ এখন মাদকের হাটবাজার। এভাবে চলছে দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর। দেরীতে হলেও সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে। দেশব্যাপী একযোগে চলছে মাদকের বিরুদ্ধে র‌্যাবের প্রশংসিত অভিযান। জানা গেছে, বাংলাদেশে মাদক চোরাচালানী ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু হয়েছে, তা হঠাৎ করেই হয়নি। এর পেছনে রয়েছে মাদক সমস্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহন করার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অভিপ্রায়।

এ অভিযানের পটভুমি ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ.টি ইমাম বিবিসিকে বলছিলেন,’ এ বছর অন্তত তিনটি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা বলেছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় এ অভিযান চলছে। মাদকের সামাজিক ঝুঁকি বর্ননা করে এইচ.টি ইমাম বলেন,’ মাদক পাচারের সাথে মানব পাচার এবং বেআইনি অস্ত্রের ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে’।

দেশের তরুন প্রজন্মকে ধ্বংসের অন্যতম উপাদান মরন ঘাতক মাদকের বিরুদ্ধে ৪ মে থেকে আইনশৃংখলা বাহিনীর শুরু হওয়া অভিযানে ’বন্দুকযুদ্ধে’ এ পর্যন্ত শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী মারা গেছে। এ ছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদক বিক্রি ও সেবনের দায়ে সারাদেশে ৮ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতা করা হয়েছে। ভ্রাম্যমান আদালতে সাজা হয়েছে ২ হাজার ৮৭৮ জনের। এদের অধিকাংশই ছোট বা মাঝারি শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী বা বাহক বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এখন পর্যন্ত ইয়াবা গড়ফাদারদের কাউকে ধরা সম্ভব হয়নি।

তবে তাদের নজরদারীতে রেখেছে র‌্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনী। ঈদের পরই তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন শুরু হবে। মাদক বিক্রেতাদের ধরতে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধের মুখেও পড়তে হয়েছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বহিনীগুলোকে। এ রকম বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে পড়ছে মাদক বিক্রেতারা। পরিস্থিতি বিরূপ বিবেচনা করে মাদকের গডফাদাররা দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। তবে তারা যাতে বিদেশ পালাতে না পারে সেজন্য সতর্ক রয়েছে একাধিক সংস্থা। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, অন্য অনেক অপরাধের সুতিকাগার হচ্ছে মাদকের বিস্তার।

অনেক দেশই মাদকের কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও অমরা মাদকের বহুমুখী কুফল প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা করেছেন.’ আমরা জঙ্গীবাদ দমন করেছি। এরবার মাদকের হাত থেকেও দেশকে উদ্ধার করব’। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মাদক ব্যবসায়ী যত বড় প্রভাবশালী হোক না কেন কেউই ছাড় পাবে না। সুত্র মতে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা শাখাসহ ৫টি সংস্থা মাদক ব্যবসায়ী এবং গডফাদারদের তালিকা তৈরী করেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সমন্বয় করে নতুন তালিকা প্রনয়ন করা হয়েছে।

তালিকায় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে ১১৫৩ জন এবং গড়ফাদার-পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ৬০ জনের নাম রয়েছে। এ ৬০ জনের মধ্যে এমপি, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের আলাদা একটি তালিকা রয়েছে। জানা যায়, মাদকের গডফাদার, প্রভাবশালী আশ্রয়দাতা ও বিনিয়োগকারীরা এখনও ধরাছোঁয়ার রাইরে। পাশাপাশি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে মাদক প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। গডফাদাররা ধরা না পড়ায় মাদকের শ্রোতও বন্ধ হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারী সংস্থার তদন্তে যেসব গডফাদার বা পৃষ্ঠপোষকের নাম এসেছে তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে মাদকের মুলোৎপাটন সম্ভব নয়। মাদক নির্মুল করতে হলে গডফাদারদের আইনের আওতায় আনার বিকল্প নেই। এ মাদক সিন্ডিকেটে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্য জড়িত থাকার বিষয়েও অভিযোগ উঠেছে। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন তারা। গডফাদারদের ৬০ জনের মধ্যে বেশিরভাগই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের। এদের মধ্যে এমপি, রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন।

তাদের ইশারায় চলছে মাদকের ব্যবসা। মিয়ানমার থেকে তাদের নির্দেশেই ইয়াবা দেশে প্রবেশ করছে। বিনিয়োগও করছেন তারা। ইয়াবা ব্যবসা করে তারা শতকোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। তাদের নিয়ন্ত্রনেই রয়েছে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এসব গডফাদারদের কথা ছাড়া একপিস ইয়াবা এদিক সেদিক যেতে পারে না। গত এক সপ্তায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বন্দুকযুদ্ধে সাতজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন।

 

এদের মধ্যে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল আলম ওরফে কানা মঞ্জু রয়েছেন। ফেনিতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন। চন্দনাইশের মাদক ব্যবসায়ী ফারুকও নিহত হন ফেনিতে বন্দুকযুদ্ধে। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী আকতার কামালের লাশ। তিনি টেকনাফের আলোচিত এমপি আবদুর রহমান বদির বড় বোনের দেবর। পুলিশ বলছে, মাদক ব্যবসায়ী দু’গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে তিনি মারা যেতে পারেন। তবে এখন পর্যন্ত কোন গডফাদার ধরা পড়েনি। বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের মধ্যে কোন গডফাদার নেই।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তালিকায় রয়েছে এমপি, রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। পুলিশ কনষ্টেবল থেকে কর্মকর্তাও রয়েছেন এই তালিকায়। তাদের মধ্যে ১) বাকলিয়া থানার এসআই মহিউদ্দিন, ২) কর্নফুলী থানার কনষ্টেবল আনিসুর রহমান, ৩) কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো: ফরিদ, ৪) এনায়েত বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এস.আই হারুন, ৫) সিআরবি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রফিক আহমেদ, ৬) কালুরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মফিজ, ৭) আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর, ৮) পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কাশেম ভুঁইয়া, ৯) বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস.এম মঈনুল ইসলাম, ১০) আকবর শাহ থানার ওসি (বদলিকৃত) আলমগীর মাহমুদ, ১০) পাহাড়তলী থানার ওসি (বদলীকৃত) মোহাম্মদ আলমগীর ছাড়াও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেত ও জনপ্রতিনিধির নাম রয়েছে এই তালিকায়।

অসংখ্য ভুল ও অসঙ্গতিপুর্ন এই তালিকা নিয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সুত্র মতে, আপাতত কোন গডফাদার ধরা না পড়লেও তাদের উপর নজরদারী করা হচ্ছে। তালিকাভুক্ত গডফাদাররা র‌্যব সহ আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর নজরদারীতে রয়েছেন। ঈদের পর কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে গডফাদারদের বিরুদ্ধে একযোগে অভিযান চালানো হবে। অভিযান চালাতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়া আছে বলে জানা গেছে। তারা যাতে বিদেশ পালাতে না পারে সে জন্য আইনশৃংখলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে বলে সুত্র জানায়। তবে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন,’ মাদকের ডন বা গডফাদার যে দলের কিংবা যেই হোক না কেন কেউই ছাড় পাবে না। তিনি বলেন,’ শেখ হাসিনার সরকারই প্রথম কথা বলেছে, অন্য কোন সরকার বলেনি। মিয়ানমার থেকে শ্রোতের মত এদেশে ইয়াবাও এসেছে। তাই মাদকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন,’ সরকারী দলের কেউ জড়িত থাকলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। প্রভাবশালী কারো নাম যদি তালিকায় আসে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না।

প্রধানমন্ত্রীর পরিস্কার নির্দেশ যে, মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে, মাদক ডিলিংসের সঙ্গে জড়িতরা যত প্রভাবশালী হোক তাদের অবশ্যই এই অভিযানের তালিকার আওতায় আনতে হবে। ওবায়দুল কাদের আরও বলেন,’মাদক বিরোধী চলমান অভিযানে যারা নিহত হচ্ছেন তারা সবাই অস্ত্রধারী এবং তারা গুলি করার পর পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি করছে। এটা বিচারবহির্ভুত হত্যা নয়, এটা এনকাউন্টার।

পুলিশ আক্রান্ত হয়ে গুলি করছে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন,’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেমন জিরো ট্রলায়েন্স ঘোষনা করেছেন, তেমনই মাদকের বিরুদ্ধেও জিরো ট্রলায়েন্স ঘোষনা করছেন। আমরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে একটি তালিকা তৈরী করেছি। যে অনুযায়ী দেশে অভিযান চলছে। মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। ছাড় দেওয়া হবে না।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.