চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগঃ না ঘরকা, না ঘাটকা!

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃঃ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এখন লেজেগোবরে অবস্থা। জেলা থেকে উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত বিরোধ-গ্রুপিং এ বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রায় সবকটি উপজেলা ও পৌরসভায় চরম বিরোধ-দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। উপজেলা পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে এ কোন্দল আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে এমন আশঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আবার এমন অভিযোগও রয়েছে, কোন কোন প্রভাবশালী নেতা এই বিরোধ জিইয়ে রেখে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চাইছেন। সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারনায় আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সীতাকুন্ডে গত ২২ সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত পথসভা স্থগিত করতে হয়েছে সংঘর্ষের আশঙ্খায়। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এই জেলায় সংসদীয় আসন রয়েছে ৭টি। কিন্তু প্রতিটিতে কোন না কোনভাবে বিরোধ রয়েছে।

এই বিরোধ কোন্দল যদি সমাধান করা না যায় তাহলে যত ঐক্যের কথা বলা হোক না কেন, সত্যিকার অর্থে নৌকার পক্ষে সে ঐক্য অনেকটা অনুপস্থিত দেখা যাচ্ছে। সীতাকুন্ড, মিরসরাই, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সন্দ্বীপ ও ফটিকছড়ি এই ৭টি উপজেলা নিয়ে গঠিত সাংগঠনিক চট্টগ্রাম উত্তর জেলা। এই ৭ উপজেলা নিয়েই ৭টি সংসদীয় আসন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব উপজেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে বিভিন্ন গ্রুপের রাজনীতি।

কোথাও প্রকাশ্যে সংঘাতের পর্যায়ে কোথাও বা অপ্রকাশ্যে এসব দ্বন্দ্ব- গ্রুপিং নির্বাচনের আগে আরও সাংঘাতিক আকার ধারন করেছে। এরই মধ্যে গত ৪ অক্টোবর ফটিকছড়ি উপজেলায় নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত এক পথসভায় মারামারি, মঞ্চ ভাংচুর সহ দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং গৃহায়ন ও গণপুর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের উপস্থিতিতেই মারামারি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে।

ফটিকছড়ির নানুপুর ইউনিয়নের আজাদীবাজার, নাজিরহাটের ঝংকার মোড়, বিবিরহাট, ভুজপুর বাজার এবং হেঁয়াকো বাজারে পাঁচটি পথসভা করার ঘোষনা দিয়েছিল উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ। আজাদী বাজারে পথসভা চলাকালে ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরীর অনুসারীদের সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস.এম আবু তৈয়বের অনুসারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষ ঘটে। এর আগে নাজিরহাটের ঝংকার মোড়ের পথসভায় মঞ্চ ভাংচুর করা হয়।

এ জন্য আবু তৈয়বের অনুসারীদের দায়ী করেন নাজিম উদ্দিন মুহুরীর অনুসারীরা। এ ছাড়া উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের পরিবারের দ্বন্দ্ব রয়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এম. তৌহিদুল আলম বাবুর সঙ্গে বিরোধ রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুল হক ও সাধারন সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরীর।

এই ফটিকছড়িতে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, সাবেক সাংসদ রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি ও ছোটভাই ফখরুল আনোয়ার আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। অপরদিকে রাজনীতির মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে পড়েছে নিজের মিরস্বরাই আসনটি ছেলের কাছে ছেড়ে দিয়ে এখানে প্রার্থী হতে পারেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গনপুর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

এ নিয়ে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত ফটিকছড়ির নেতাদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ। তবে তৃনমুল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে গনমানুষের কাছে সাহায্য সহযোগিতা করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী সাদাত আনোয়ার সাদী। তিনি ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য ও দানবীর শিল্পপতি হিসেবে পরিচিত।

অপরদিকে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত সীতাকুন্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। সব ধরনের প্রস্তুতি থাকলেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন কোন্দলের কারনে সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্খায় গত ২২ সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদকের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় প্রচার টিমের পথসভাও বাতিল করতে হয়েছে। কয়েকটি ধারায় বিভক্ত সীতাকুন্ড আওয়ামী লীগের গ্রুপিং-কোন্দলের কারনে সংঘাত-সংঘর্ষ লেগেই থাকে। বর্তমান সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের রয়েছে একটি গ্রুপ, অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান এস.এম আল মামুনের এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল বাকের ভুঁইয়ার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সক্রিয়।

তিনজনই আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে এসব গ্রুপের রাজনীনি সংঘাতমুখর হয়ে উঠেছে। তবে সেখানে তুলনামুলক ভাল অবস্থানে আছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল বাকের ভুঁইয়া। তৃনমুল পর্যায়েও রয়েছে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক গ্রহনযোগ্যতা।

সন্দ্বীপের এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যান মাষ্টার শাহজাহান বিএ’র। তারা দুজনে এক মঞ্চে বসে দলীয় কর্মসুচী পালন করলেও বিরোধ মেটেনি। এ বিরোধে যুক্ত আছেন সন্দ্বীপের পৌর মেয়র জাফরুল্লাহ টিটুও। এসব দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং তৃনমুলে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনের আগে এই বিরোধ নিস্পত্তি না হলে আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে জানান নেতাকর্মীরা। বর্তমান এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা, ডা. জামাল উদ্দিন ও মাষ্টার শাহজাহান আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। হাটহাজারীতে দলের উত্তর জেলার সাধারন সম্পাদক এম.এ সালামের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আছে যুগ্ন-সাধারন সম্পাদক ইউনুস গনি চৌধুরীর। এ আসনে তৃনমুল পর্যায়ে ইউনুছ গনি চৌধুরীর অবস্থান ভাল।

রাঙ্গুনিয়ায় কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বর্তমান এমপি ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ওসমান গনি চৌধুরীর। আগামী নির্বাচনে তিনজনই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী তালিকায় রয়েছেন। এদিকে রাউজানে পর পর তিনবারের সংসদস সদস্য এবিএম ফজলে করিমের সঙ্গে রাউজান পৌর মেয়র দেবাশীষ পালিতের বিরোধ প্রকাশ্য। সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার রোটনের সঙ্গেও রয়েছে ফজলে করিম চৌধুরীর দ্বন্দ্ব। আগামী নির্বাচনে বর্তমান এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ও মাহফুজুল হায়দার রোটন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী।

মিরস্বরাইতে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে তীব্র বিরোধ আছে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলার সহ-সভাপতি গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। এ বিরোধের কারনে উত্তর জেলা কমিটিতে প্রথমে যথাযথ পদ পাননি গিয়াস। পরে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে তাকে সহ-সভাপতি করা হয়। উত্তর জেলার অন্যান্য পদে থাকা ব্যক্তিরা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন স্থানীয় পর্যায়ে।

কোন্দলের কারনে বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উত্তর জেলার ৭ টি উপজেলার মধ্যে একমাত্র মিরসরাইতে চেয়ারম্যান পদে জিততে পারেনি আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে তৎকালীন চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিনকে দলীয় সমর্থন না দিয়ে দেয়া হয়েছিল মন্ত্রীর অনুসারী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতউর রহমানকে। গিয়াস উদ্দিন এতে প্রার্থী হন। ফলে নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গিয়াস উদ্দিন। আর আতাউর রহমান হন তৃতীয়।

বিরোধ-কোন্দল ও গ্রুপিং চর্চা রয়েছে সহযোগী সংগঠনের মধ্যেও। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী একাধিক হাতবোমা বিস্ফোরন ও দুটি পক্ষের মারামারির কারনে পন্ড হয়ে যায় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন। চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়াস ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গৃহায়ন ও গনপুর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে গনপুর্তমন্ত্রী মাইকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। এতে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে এক পর্যায়ে সম্মেলনের বাইরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ফাঁকা গুলিবর্ষন করে। তবে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতার মতে.’ যেসব এলাকায় টুকটাক সমস্যা আছে তা নিরসনে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। নির্বাচনের জন্য আমারা প্রস্তুত। বড় দল হিসাবে নির্বাচনে অনেকেই মনোনয়ন চাইতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেন তার পক্ষে সবাই মিলেমিশে কাজ করবে’।

জানা গেছে, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা নড়বড়ে হওয়াতে সংগঠনের কর্মকান্ডে কোন গতি নেই। চেন অব কমান্ড না থাকাতে ৭টি উপজেলায় প্রকাশ্যে গ্রুপ ও উপগ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। মিছিল, সভা, সমাবেশে পৃথকভাবে অনুষ্টিত হচ্ছে। কোন শৃঙ্খলা নেই দলের মধ্যে। প্রত্যেক উপজেলায় যত নেতা তত গ্রুপ। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ না ঘরকা, না ঘাটকায় পরিনত হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ৭টি উপজেলায় চরম কোন্দল ও বিশৃঙ্খলা দলের ভাবমুর্তিকে মারাত্বকভাবে ব্যাহত করছে। যে কারনে ৭টি উপজেলায় তৃনমুলে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। আগামী নির্বাচনে হয়ত দলকে এর মাশুল দিতে হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.