চট্টগ্রাম নাজিরহাট পৌরসভায় আওয়ামী লীগের গাজন নষ্ট

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটি নিউজ : এক সময় ফটিকছড়ি ছিল সন্ত্রাসের জনপদ। আয়তনে ফেনী জেলার সমান বৃহত্তর উপজেলা ফটিকছড়ি। পাহাড় ও সমতল ভুমি বেষ্টিত প্রাকৃতিক সম্পদের অপুর্ব আধার ফটিকছড়ি ছিল পিছিয়ে পড়া উপজেলা। পরিচিতি ছিল বাংলার ল্যাবানন ফটিকছড়ির রণাঙ্গন হিসেবে। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রফিকুল আনোয়ার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ফটিকছড়িতে অভুতপুর্ব উন্নয়ন সাধন করে পরিনত করেন উন্নয়ন ও অগ্রগতির জনপদে। আওয়ামী লীগের দুর্গ-খ্যাত ফটিকছড়িতে এসে পড়ে ঘাতকের থাবা।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি হন এখানে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভুজপুরে নেতাকর্মীদের শান্তির মিছিলে চালানো হয় ইতিহাসের বর্বরোচিত হামলা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় শত-শত যানবাহন। পেট্রোল বোমা ও সন্ত্রাসের বিভিষীকায় পঙ্গুত্ব বরন করে অনেক নেতাকর্মী। পুলিশের ষাড়াশি অভিযানে বিএনপি-জামাত ক্যাডাররা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়। কিছুটা শান্তি নেমে আসে ভুঁজপুর সহ গোটা ফটিকছড়িতে।

সেই ফটিকছড়ির নবগঠিত নাজিরহাট পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে লজ্বাজনক ভাবে হেরেছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী। ব্যাংক ঋন খেলাপীর কারনে প্রার্থীতা বাতিলের পর উচ্চাদালত থেকে প্রার্থীতা ফিরে পাওয়া এই প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। ভোটের অংকে তার চেয়ে দ্বিগুন ভোট পেয়েছেন বিএনপির প্রার্থী সিরাজ উদ দৌলা। এলাকায় বিএনপির সাংগঠনিক নাজুক অবস্থায় দলটির প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ের পর চমকে উঠেছে মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরও ফটিকছড়ির নাজিরহাট পৌরসভায় করুন পরিনতি কেন? খবর নিয়ে জানা গেছে চমকপ্রদ তথ্য। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে মায়াকান্না করলেও নেতারা মনেপ্রাণে চাননি দলীয় প্রাথী জয়লাভ ।

নির্বাচনের ৩ দিন আগে থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মী দুরে সরে যায়। শুরু থেকে সমন্বয় ছিলনা দলীয় প্রার্থীর নির্বাচনি প্রচারনায়। দীর্ঘদিন ধরে যত নেতা ততো গ্রুপ এবং উপ-গ্রুপে বিভক্ত ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি।

উত্তর জেলা ও ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের অদুরদর্শী সিদ্ধান্ত, নেতাদের পকেট বাণিজ্য ও অসাংগঠনিক কর্মকান্ডের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী পরিবারের লোকজন। এ ধারায় রয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল আলম বাবু, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বানিজ্য সম্পাদক ফখরুল আনোয়ার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক চেয়ারম্যান সোলায়মান, উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক এইচ.এম আবু তৈয়ব সহ একাধিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।

জানা গেছে, ’দলীয় প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরীর প্রার্থীতা বাতিল হবার পর জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ যখন কিংকর্তব্যবিমুঢ় তখন পৌরসভা আওয়ামী লীগের সদস্য ও মেয়র পদে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী আনোয়ার পাশাকে সমর্থন দেন উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল আলম বাবু। বিপরীতে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ কর্মীসভা করে জানান,’ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থীতা যেহেতু বাতিল হয়েছে তাই যার যেখানে ইচ্ছে ভোট দিতে পারেন। এরই মধ্যে নাটকীয়ভাবে শেষমুহুর্তে দলীয় প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী উচ্চাদালত থেকে প্রার্থীতা ফিরে পেলেও হারিয়ে ফেলেন ভোটারদের। যে কারনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোট পড়েছে বিএনপি প্রার্থীর বাক্সে। এ অভিমত স্থানীয় প্রবীন নেতাকর্মীদের।

উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য নুরুল আলম চৌধুরী ফটিকছড়ির কৃতিসন্তান। তাঁর নিজের এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের কারন জানতে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। একই ভাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেওয়া সাবেক এমপি রফিকুল আনোয়ারের কন্যা খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। উপজেলা আওয়ামী লীগের এক প্রবীন নেতা বলেন,’ আওয়ামী লীগের অতিসন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’।

এদিকে ফলাফলে নাজিরহাট পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে জয়লাভ করেছেন বিএনপি মনোনীত এস.এম সিরাজ উদ-দৌলাহ (ধানের শীষ) । গত ২৯ মার্চ ফটিকছড়ির নাজির হাট পৌরসভার প্রথম নির্বাচন শান্তিপুর্নভাবে অনুষ্টিত হয়েছে। সকাল ৮ টা থেকে ভোট গ্রহন শুরু হয়ে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে। এ সময় সব কেন্দ্রে পুরুষের পাশাপাশি মহিলা ভোটারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। নাজিরহাট পৌরসভায় র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশের পাশাপাশি একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে ৭ জন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন।

দুপুর ১টার দিকে মধ্য দৌলতপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে ম্যাজিষ্ট্রেট মনছুরের নেতৃত্বে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে মেয়র পদে জয়লাভ করেছেন বিএনপি মনোনীত এস.এম সিরাজ উদ দৌলাহ (ধানের শীষ) তার প্রাপ্ত ভোট ৯ হাজার ৫৮২ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুল হক চৌধুরী (নৌকা), তার প্রাপ্ত ভোট ৪ হাজার ৫৯৩।

এ নির্বাচনে মেয়র পদে তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী মো: শাহজালাল (ফুলের মালা) পেয়েছেন ৭ শত ৯ ভোট। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে আনোয়ার পাশা (নারিকেল গাছ) ২ হাজার ৩শত ২৬ ভোট, শতন্ত্র প্রার্থী মো: আলী আজম (মোবাইল ফোন) ৩ হাজার ২ শত ৬২ ভোট, এম.এ হায়াত (জগ) ৩ হাজার ৭শত ৩০ ভোট ও সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী (কম্পিউটার) ৭৬ ভোট পেয়েছেন। সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলররা হলেন ১নং ওয়ার্ডে ছলিমা আকতার (জবা ফুল) ২নং ওয়ার্ডে রেজিয়া বেগম (জবা ফুল) ৩নং ওয়ার্ডে আয়েশা আক্তার (চশমা) নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে মেয়র পদে ৭ জন, সাধারন কাউন্সিলর পদে ৬৪ ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ১১ জন সহ ৮২ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে মোট ভোট কেন্দ্র ১২ টি। ভোটারের সংখ্যা ৪০ হাজার ৮৫ জন। তম্মধ্যে পুরুষ ভোটার ২০ হাজার ৬শত ৭৭ জন এবং মহিলা ভোটার ১৯ হাজার ৪ শত ৮ জন। কাউন্সিলর পদে নির্বাচিতরা হলেন ১নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন (পাঞ্জাবী), ২নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ আমান উল্লাহ (পাঞ্জাবী), ৩নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ হারুণ(উট পাখি), ৪নং ওয়ার্ডে মহিন উদ্দিন মঈনু (ফাইল কেবিনেট) ৫নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ মনছুর (টেবিল ল্যাম্প), ৬নং ওয়ার্ডে মাওলানা এয়াকুব (টবিল ল্যাম্প), ৭নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ ইসমাইল (ব্ল্যাক বোর্ড), ৮নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ আলী (পানির বোতল) ও ৯নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ সোলায়মান (ফাইল কেবিনেট)।

আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ মহলের মতে,’ ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগ মনোনীত মহাজোট’এর সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর দল তরিকত ফেডারেশনের মেয়র প্রার্থী শাহজালাল পেয়েছে মাত্র ৭শত ৯ ভোট। ভোটের এই অংকে বোঝা যাচ্ছে সেখানে তরিকত ফেডারেশনের গ্রহনযোগ্যতা শুন্যের কোটায়। অপরদিকে নাজিরহাট পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়ি হওয়াতে নতুন উদ্যম ফিরে এসেছে উত্তর জেলা বিএনপিতে। পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর জয়কে কাজে লাগিয়ে জাতীয় নির্বাচনেও এ ধারা অব্যাহত রাখতে চায় উত্তর জেলা।

ড্যাব সভাপতি ও উত্তর জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী বলেন, ’উত্তর জেলা বিএনপির প্রমান নাজিরহাট পৌরসভার ফলাফলে মেলে। আমরা এ নির্বাচনকে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ফরমায়েশি রায়ের প্রতিবাদ হিসেবে নিয়েছিলাম। জনগন সেটার জবাব দিয়েছে। একই বিষয়ে চাকসু ভিপি নাজিম উদ্দিন বলেন, ’নাজিরহাট পৌরসভার নির্বাচন প্রমান আওয়ামী লীগের ভরাডুবির আগাম চিত্র। যদি সুষ্ট নির্বাচন হয়, সারাদেশে একই চিত্র হবে’। উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ন সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন বলেন, ’এ নির্বাচনের ফলাফল প্রমান করে সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই’। এ বিজয় আগামী দিনে ফটিকছড়ির রাজনীতিতে বেশ প্রভাব ফেলতে পারে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.