চন্দনাইশে আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক স্থাপন
সিটি নিউজ, চন্দনাইশঃঃ স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম শঙ্খ নদীর দু’কূলের মানুষ শঙ্কা ছাড়াই বর্ষা মৌসুম পার করতে পেরেছে। প্রতি বছর বর্ষা এলেই শঙ্খ নদীর দু’পারের মানুষের দিন কাটত দুর্ভোগ-দুর্গতি আর মৃত্যুশঙ্কায়। কখন শঙ্খ নদীর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে নিয়ে যায় ভিটে-বাড়ি, জমি-জিরাত। বর্ষা মৌসুমে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েই কাটত শঙ্খ তীরবর্তী এলাকার মানুষের জীবন।
শঙ্খ নদীতে প্রতি বছরে ভয়াবহ ভাঙ্গনের শঙ্কায় দিন কাটত প্রতি বর্ষায়, রাত কাটিয়েছে নির্ঘুম। সাতকানিয়ার উত্তর কালিয়াইশ মাইঙ্গাপাড়া গ্রামের শঙ্খ উপকূলবর্তী ষাটোর্ধ্ব আবদুল মালেক বলেছেন, জীবনের ৬০টি বছর পেরিয়ে এসে এবারই প্রথম বর্ষা মৌসুমে খরশ্রোতা শঙ্খের ভাঙ্গনের শঙ্কা ছাড়াই নিশ্চিন্তে রাত যাপন করতে পেরেছেন।
আর এটি সম্ভব হয়েছে ভাঙ্গনরোধে দু’পাড়েই ব্লক স্থাপনের কারণে। অধশর্ত বছর পর শঙ্খ নদীর ভাঙ্গনে এবারই প্রথম কোনো ঘরবাড়ি শঙ্খ নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়নি। তিনি ছাড়াও শঙ্খ নদীর তীরবর্তী চন্দনাইশ-সাতকানিয়া উপজেলার ১০ গ্রামের দেড় লক্ষাধিক মানুষের একই কথা।
এ বছর বর্ষা মৌসুমে এসব মানুষের মাঝে ছিল না কোন উৎকণ্ঠা। মৌসুমে সৃষ্ট একাধিকবারের বন্যা ও পাহাড়ি ঢল তাদের ধান, সবজিসহ নানা ফসলের ক্ষেত ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও তাদের মনে খুব বেশি দুঃখ ছিল না। তারা জানান, চট্টগ্রাম-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব নজররুল ইসলাম চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শঙ্খ নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে ২ শত ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক স্থাপন করা হয়। ফলে এ বছর বর্ষা মৌসুমে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়নি শঙ্খ পাড়ের এসব বাসিন্দাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শঙ্খ নদীর দু’পাড়ে প্রতি বছরের ভাঙ্গন থেকে শত শত ঘরবাড়ি, হাজার হাজার একর জমি ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা রক্ষা পেয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত গ্রামগুলোতে নদীর দু’পাড়ে পৌনে ১১ কিলোমিটার ব্লক স্থাপন করায় চলতি বছরে শঙ্খের ভাঙ্গনে একটি ঘরও নদীতে তলিয়ে যায়নি। গৃহহারা হয়নি একটি পরিবারও, বিলীন হয়ে যায়নি এক খন্ড জমিও।
ভাঙ্গন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়ার কারণে এবার যেসব এলাকা শঙ্খের ভাঙ্গন থেকে পুরোপুরি রক্ষা পেয়েছে চন্দনাইশের ধোপাছড়ি বাজার, রায়জোয়ারা, চাগাচর, জাফরাবাদ, চর-বরমা, বরমা, বৈলতলী ও সাতকানিয়া উপজেলার মনেয়াবাদ, বোমাংহাট, কুন্ডকুল, উত্তর কালিয়াইশ, মাইঙ্গাপাড়া, আমিরখিলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।
শঙ্খ পাড়ের বাসিন্দা আহমদ কবির, সাইর আহমদ সাইদ, আবুল কালাম আজাদ, সোনা মিয়াসহ অনেকেই শঙ্খের ভাঙ্গনরোধে ব্লক স্থাপন করায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, জন্মের পর থেকেই তারা শঙ্খের ভাঙ্গনের ভয়াবহতা দেখে আসছে। কখনো ভাবতে পারেনি ভাঙ্গন প্রতিরোধে কেউ এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর এলাকায় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী শঙ্খ পারের ১০ গ্রামের কয়েক সহ¤্রাধিক পরিবার শঙ্খের ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেয়েছে বলেও জানান।
শঙ্খ পাড়ের গ্রামগুলো সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, ১৯৭১ সালের পূর্ব থেকে শঙ্খের দু’পাড়ে ভাঙ্গন শুরু হয়। সে সময় থেকে বিগত ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় প্রায় দশ সহস্রাধিক বাড়ি-ভিটে। তাছাড়া শত শত একর ফসলি জমি, অর্ধ শতাধিক মসজিদ, মন্দির, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, মাজার, কবরস্থান, শ্মশানসহ অসংখ্য স্থাপনা।
বছরের পর বছর খরশ্রোতা শঙ্খের ভাঙ্গনে প্রতি বর্ষা মৌসুমে ভিটে-বাড়ি, জমি-জিরাত হারিয়ে ভূমিহীন হয় হাজার হাজার পরিবার। ভাঙ্গনের কারণে সর্বস্ব হারিয়ে অনেক পরিবার দিনমজুরে পরিণত হয়। পাশাপাশি ভিটেহারা অনেকেই থাকার জায়গা না পেয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেও বাধ্য হয়। এমনকি শঙ্খের ভাঙ্গনে চন্দনাইশ-সাতকানিয়া উপজেলার মানচিত্রও পাল্টে গেছে অনেক ক্ষেত্রে। এত ক্ষয়-ক্ষতির পরও এ দীর্ঘ সময়ে ভাঙ্গন প্রতিরোধে কেউ এগিয়ে আসেনি।
ফলে কোন বাধা ছাড়াই বেড়েছে শঙ্খের ভাঙ্গন। মাঝখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে একাধিকবার ভাঙ্গন প্রতিরোধে চেষ্টা করা হলেও তাতে ভাঙ্গন আতংকে থাকা মানুষগুলোর তেমন উপকার হয়েছে এমনটি শোনা যায়নি। ভাঙ্গন আতংকে মানুষের উৎকন্ঠা যখন বেড়ে চলছিল, তখন এগিয়ে আসেন এলাকার সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অনেক চেষ্টা তদবিরের মাধ্যমে শঙ্খের ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ২শ ২০ কোটি টাকার বিশাল অর্থ বরাদ্দ করাতে সক্ষম হন।
গত ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়েই শুরু হয় শঙ্খের ভাঙ্গন প্রতিরোধের কাজ। পুরো এলাকায় ভাঙ্গন প্রতিরোধের কাজ চলাকালীন এলাকার লোকজন সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তারা স্বেচ্ছাশ্রমে ঠিকাদারদের অনেক কাজে অংশগ্রহণ করে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রায় ২ বছরের মত সময় কাজ করে চলেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার।
এখনও ব্লক স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। কাজ শেষ না হলেও শঙ্খ পাড়ের মানুষগুলো পেয়ে গেছে ব্লক স্থাপনের সুফল। শঙ্খের ভাঙ্গন প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন, শঙ্খের ভাঙ্গনরোধ। শঙ্খ নদীর ভাঙ্গন কবলিত লোকগুলোকে তাদের দুর্দশা থেকে রক্ষা করা।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে শঙ্খের ভাঙ্গনের ব্যাপারে সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করা হলে তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে ভাঙ্গন প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে ২শ ২০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দিয়ে শঙ্খের ভাঙ্গনরোধে কাজ শুরু করা হয়।
ফলে শঙ্খ নদীর পৌনে ১১ কিলোমিটার ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় ব্লক স্থাপন করার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে তিনি জানান। এ প্রথম কোন বর্ষা মৌসুমে শঙ্খ নদীর গর্ভে একটি ভিটেবাড়িও বিলীন হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড, পটিয়ার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা অরূপ চৌধুরী জানান, চলতি বর্ষা মৌসুম শেষে শঙ্খের ভাঙ্গন প্রতিরোধের বাকী কাজগুলোও সু-সম্পন্ন করা হবে। ব্লক স্থাপনের কাজ শেষ হলে ভাঙ্গন প্রতিরোধের সাফল্য শতভাগ নিশ্চিত হবে।
শঙ্খের ভাঙ্গন প্রতিরোধে সরকারি গৃহীত এ মহা পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলা যায়, গত ২ বর্ষা মৌসুমে একাধিকবার বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে শঙ্খ নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র খরশ্রোতা শঙ্খ নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেয়েছে। অক্ষত রয়েছে ঘর-বাড়ি, ফসলি, আবাদি জমি ও অসংখ্য স্থাপনা।