দেউলিয়ার পথে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক

0

অর্থ ও বাণিজ্য, সিটি নিউজ :: রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক এখন দেউলিয়ার পথে। ব্যাংকটি থেকে গত ৮ বছরে বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানির নামে আট হাজার কোটিরও বেশি টাকা পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে বার বার জনগণের করের টাকা দেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ গত জুন মাসে ব্যাংকটিকে মূলধন ঘাটতি পূরণে একহাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। আর গত ৪ বছরে বেসিক ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টিই লোকসান গুনছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই ব্যাংকটির অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণের উচ্চহার। বর্তমানে ব্যাংকটির ৫৯ দশমিক ২২ শতাংশই খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির এখন খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মাজিদ বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া হয়। শীর্ষ খেলাপিদের বড় একটা অংশকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা তাদের অনেককে খুঁজে পাইনি। যেসব গ্রাহককে আমরা ধরে এনেছিলাম, কিন্তু তারাও ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।

সব টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় আমরা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ রিসিডিউল করেছিলাম, কিন্তু দেখা গেল, সেখানকার তিন হাজার কোটি টাকাও চলে গেছে। এ জন্য টাকা উদ্ধারে অন্য কোনও পথ বের করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে দেশের কোনও ব্যাংকই ভালো অবস্থায় নেই। তার মধ্যে বেসিক ব্যাংকের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বেসিক ব্যাংকের এই পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ি, তাদেরকে শাস্তি দেওয়া জরুরি। ব্যাংকটি থেকে বের হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হলেই কেবল ব্যাংকটি টিকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগরসহ কয়েকটি শাখা থেকে নামসর্বস্ব শতাধিক কোম্পানির নামে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় অনিয়মের মাধ্যমে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েকটি ঋণ প্রস্তাব নিয়ে ব্যাংকের শাখাগুলো থেকে পর্যবেক্ষণে নেতিবাচক জানানো হওয়ার পরও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ঋণ সংক্রান্ত কমিটি তা উপেক্ষা করে ঋণ অনুমোদন করে।

ওই ঘটনায় এমডিকে বরখাস্ত করে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। পরে আলাউদ্দিন এ মজিদকে চেয়ারম্যান এবং খোন্দকার মো. ইকবালকে এমডি করে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়। কিছুটা গতি আসে ব্যাংকটিতে। তবে মুহাম্মদ আউয়াল খান এমডি হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর আবারও গতি হারিয়েছে ব্যাংকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে তৎকালীন চেয়ারম্যান, এমডি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। টানা পাঁচ বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, লোকসান এবং মূলধন ঘাটতি নিয়ে কোনও রকমে টিকে আছে ব্যাংকটি।

বেসিক ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি গত বছরে ৬৮৪ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। সব মিলিয়ে গত চার বছরে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালেও প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি।

২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়। পরের বছর ২০১৩ সাল থেকে লোকসান শুরু হয়। ২০১৩ সালে ৫৩ কোটি, ২০১৪ সালে ১১০ কোটি, ২০১৫ সালে ৩১৪ কোটি ও ২০১৬ সালে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করে বেসিক ব্যাংক।

এদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালে এই ব্যাংকটিতে নানা ধরনের অনিয়মের কারণে সব সূচকের অবনতি হয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে,গত মার্চ শেষে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩০৭ কোটি। এছাড়া ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। যদিও গত পাঁচ অর্থবছরে বেসিক ব্যাংকে ৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

উল্লেখ্য, বেসিক ব্যাংকে বিপর্যয়ের শুরু হয় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সময়ে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ওই সময়েই ঘটে বড় অংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান হওয়ার পর ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত (চার বছর তিন মাসে) ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ঋণ বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ার পর প্রথমে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়।

২০১৪ সালের ২৯ মে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর ৪ জুলাই অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে পদত্যাগপত্র দেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু।

পরে বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৫ সালে সর্বমোট ৫৬টি মামলা করে দুদক। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের কাউকেই মামলাগুলোতে অভিযুক্ত করা হয়নি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.