প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে দুদকের ৮ প্রস্তাবনা

0

সিটিনিউজ ডেস্ক:: সারাদেশে যত জায়গায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এসব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারি লোকজন জড়িত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব সার্কুলার দিয়েই সারাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্নীতি মুক্ত করা সম্ভব। রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক বৈঠকে দুদক কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন এসব কথা বলেন। এ সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

দুদক কমিশনার বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডির কার্যক্রমসহ প্রতিটি সাধারণ কাজ অনলাইনভিত্তিক করার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস কীভাবে ঠেকানো যায় এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে দুদক ৮টি প্রস্তাবনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে— প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে মেধাবী, সৎ এবং মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষক বাছাই করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা। প্রতিটি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে ইংরেজি অনুবাদের জন্য একজন অনুবাদক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণে যারা থাকবেন তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকারনামা নিতে হবে যেখানে উল্লেখ থাকবে তাদের নিজেদের সন্তান কিংবা পোষ্য সংশ্লিষ্টরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন না অর্থাৎ স্বার্থের দ্বন্দ্ব যেন না থাকে। এ অঙ্গীকারনামা যাচাই পূর্বক তাদের মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে।

প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত মডারেটরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। প্রশ্নপত্র বিশেষ লক সংবলিত বক্সের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রিট ও শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিটি ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র পাঠাতে হবে। ডাবল লক সংবলিত এই তালা জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে খোলা হবে এবং একই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রশ্নপত্র উপজেলা পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো যেতে পারে।

প্রস্তাবে বলা হয়, পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় সর্বোচ্চ দুইটির বেশি পরীক্ষা কেন্দ্র রাখা সমীচীন হবে না। পরীক্ষা কেন্দ্রসমূহ উপজেলা শহরেই থাকা বাঞ্চনীয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে যে সকল অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা করাসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করতে হবে (যেহেতু অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়) অথবা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করতে হবে।

প্রস্তাবনায় বলা হয়, এ ধরনের সকল অপরাধে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট থাকলে দুদক এ সকল মামলা অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে দুদক আইনে মামলা করতে পারে। শিক্ষা সংক্রান্ত সকল কাজ অনলাইন সার্ভিসের আওতায় আনা প্রয়োজন বলেও প্রস্তুাবে উল্লেখ করে দুদক।

এছাড়াও কোটিং ও নোট-গাইড বাণিজ্য ঠেকাতে ৮টি, বেসরকারি অর্থাৎ এমপ্রিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত করতে ৫টি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবি’র কার্যক্রম স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করতে ৫টি প্রস্তাবনা তুলে ধরে দুদক।

সভায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বেশকিছু দুর্নীতির উৎস তুলে ধরে দুদকের প্রস্তাবনায় বলা হয়, অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি যেমন টেন্ডারের তথ্য ফাঁস, নেগোসিয়েশনের নামে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সাপোটিং বা এজেন্ট ঠিকাদার নিয়োগ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, টেন্ডারের শর্তানুসারে কাজ বুঝে না নেওয়া, মেরামত বা সংস্কার কাজের নামে ভুয়া বিল ভাউচার করে অর্থাৎ আত্মসাৎ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তদের বেনামে অথবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা করা।

এসব সমস্যা উত্তরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ৭টি প্রস্তাব পেশ করে দুদক প্রতিনিধি দল।

দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও প্রতিনিধি দলের প্রধান ড. নাছির উদ্দিন বলেন, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে শিক্ষা, তারপর স্বাস্থ্য। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কি ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই।

তিনি বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ শিক্ষার্থীদের অর্ন্তনিহিত মেধা ও সম্ভাবনা পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করতে হবে। আামাদের মাঠ পর্যায়ের যে অভিজ্ঞতা তা থেকে বলতে পারি প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে চাইলে যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াকে অনলাইন ব্যবস্থায় আনতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্যাশ ট্রানজেকশনে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। কিন্তু তা অনলাইনে চালু করার কারনে ইনকাম অনেক বেড়ে গেছে। দুর্নীতির লিকেজগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ড. নাছির বলেন, শিক্ষামন্ত্রীকে আমি অনুরোধ করি ‘আমি এবং আমার বিদ্যালয় দুর্নীতি মুক্ত’ কথাটা প্রতিটি বিদ্যালয় ও কলেজে প্রতিষ্ঠান প্রধান সই করে টাঙিয়ে রাখতে ব্যবস্থা করুন। আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ করে দেখেছি শিক্ষকদের সাথে সরকারি লোকদের মিটিং হচ্ছে না। এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সমস্যা হচ্ছে আমাদের একশটি অর্জনে কোনো কথা নাই। একটি ছোট সমস্যার জন্য মনে হয় দেশ উল্টে যায়। দুদকের পর্যবেক্ষণ ভাল। আমরা বিষয়গুলো বাস্তবায়ণে চেষ্টা করব।

সভায় দুদক পরিচালক মীর মো: জয়নুল আবেদিন শিবলি বলেন, দেশের ২৪টি স্কুলে ৫৫২ জন শিক্ষক ১০ থেকে ৩৩ বছর পর্যন্ত একই স্কুলে আছেন। এ তথ্য মাওশির তথ্য থেকেও পাওয়া। এমনকি যারা বদলি হন তারা অধিকাংশই একই এলাকায় বা মহানগরীতেই থাকেন। এ ধরনের সমস্যার কারণে শিক্ষকরা দুর্নীতির সাথে যুক্ত হচ্ছেন।

সভায়, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও দুদকের ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

দুদকের মতো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দাবি করেছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে কোচিং সেন্টার, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ জড়িত। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থের লেনদেন হয়।

সম্প্রতি টিআইবির প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত চার বছরে এসএসসি, এইচএসসি, জেএসসি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা ও শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতাও রয়েছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.