যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী এখন দিনমজুর

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ আমাদের মহান স্বাধীনতা ও সার্বভৌম ভুখন্ড বাংলাদেশের সবুজ জমিনের ওপর রক্তখচিত লাল সবুজ পতাকা। বিশ্ব দরবারে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্বমর্যাদা সমুন্নত হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সরকারী বেসরকারী আমলা-কর্মচারী তথা দেশের মুল অবকাঠামোসহ সকল কিছুরই অস্তিত্ব ও ভিত্তি রচিত হয়েছে ’৭১ এ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপুর্ন অবদানে।

যাদের আত্বত্যাগে এই দেশ, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার কতোটা ভাল আছে? এখনো পত্রিকায় খবর আসে ’৭১ এর সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা রিক্সা চালায়, পেটের দায়ে বেছে নিয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি। বেঁচে থাকতে খবর নেই, মৃত্যুর পর ‘রাষ্ট্র্রীয় মর্যাদায় দাফন’ নামের উপহাস। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা চাকরী না পেয়ে পুটপাতের কিংবা বাসের কন্টাক্টর হয়। মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী অন্যের বাড়িতে ঝি’এর কাজ করে সংসার চালায়।

একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারী উর্ধতন কর্মকর্তা গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেন আর লজ্জা ও অপমানে যিনি আত্বহত্যা করেন! এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, সহায় সম্পদ লুটপাট, শহীদ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে পিটিয়ে জখম, মুক্তিযোদ্ধার কন্যা ও পরিবারের নারীর উপর সমাজ বিরোধী, সন্ত্রাসী, অপরাধী, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির রাজাকার ও তাদের পোষ্যপুত্র, বিষাক্ত বংশধরদের অপহরন নির্যাতনের খবর পড়তে হয় যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ।

১৯৯৬ সালে, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল ও জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের কল্যাণকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করেন। ২০০১ সালের বিএনপি-জামাত জোট আমলের পুর্ব পর্যন্ত যা বলবত ছিল। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাতের স্বাধীনতা বিরোধী দল ও শাসকগোষ্ঠী, পুর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মসূচী ও সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁট করে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের অনিশ্চিত এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে নিক্ষিপ্ত করে।

২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার পুনরায় সরকার গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের ভাতা বৃদ্ধিকরণ সহ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচী ও পদক্ষেপ গ্রহন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের এসব পদক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নতুন জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে কেন এখনো অসহায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের করুন অর্তনাদ শুনতে হয়। অভাবের তাড়নায় মুক্তিযোদ্ধা বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তি, অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় পক্ষু মুক্তিযোদ্ধার। কেন মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী স্বামীর ভাতার টাকার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। সন্তানদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী কেন অন্যের বাড়িতে চাকরের কাজ করে।

যার নাম রয়েছে লাল মুক্তিবার্তায় এবং গেজেটে। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটেও তার নাম রয়েছে। মৃত্যুর কয়দিন আগেও যিনি ভাতা উত্তোলন করেছেন। যার মৃত্যুতে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্মান। মৃত্যুর পরই সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়াত এই মুক্তিযোদ্ধার নাম নুর আহমদ, পিতা-মৃত আশকর আলী, গ্রাম-মাদার্শা, ডাকঘর-দেওদিঘী, উপজেলা-সাতকানিয়া, জেলা-চট্টগ্রাম। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সপক্ষে যতগুলো ডকুমেন্ট থাকার কথা সবকিছু তার রয়েছে। তার লাল মুক্তিবার্তা নম্বর-০২০২০৬০১৯১, ভারতীয় তালিকা নম্বর-১০২৯১, তারিখ-২২/১১/২০০৫ইং, গেজেট নম্বর-২৯৫০, তারিখ-২২/১১/২০০৫ইং, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নামে ইস্যুকৃত পরিচয়পত্র নং-১৮৮৮, রেজিষ্টার নম্বর-১২০, তারিখ-২৬/০৫/১৯৯৯ইং।

বিগত ৩০-১১-২০০৩ইং তারিখে তিনি বার্ধক্যজনিত কারনে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৩ কন্যা ৩ পুত্র ও স্ত্রীকে ওয়ারিশ রেখে যান। সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও রহস্যজনকভাবে এই প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। জানা যায়, মাসিক সম্মানী ভাতা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তার ২ মেয়ের বিয়ের জন্য ৪ হাজার টাকা করে ৮ হাজার টাকা সাহায্য প্রদান করেন। এর পর ২১-০২-৯৭ইং প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আরেকটি আর্থিক সাহায্যের আবেদন করেন।

যার প্রেক্ষিতে ৩১-০৩-৯৮ তারিখে, প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক লিয়াজো অফিসার আলহাজ্ব মো: বজলুর রহমান স্বাক্ষরিত ১৪৯ নং পত্রে জানানো হয়, তার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩/১০/২০০০ইং তারিখে ৬৩২নং পত্র মতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এর পরিচালক (কল্যাণ) সালাহ উদ্দিন মিয়া স্বাক্ষরিত পত্রে উক্ত মুক্তিযোদ্ধার নামে এক জোড়া ক্রাচ এর মুল্য বাবদ ১২০০ টাকা মঞ্জুর করা হয়।

জানা যায়, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুর আহমদ অতিশয় একজন দরিদ্র ব্যক্তি ছিলেন। অভাব অনটনের কারনে ঠিকমত চিকিৎসা করতে পারেন নি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুর আহমদের মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী ছফুরা খাতুন ২৩/০২/২০১৭ইং তারিখে সাতকানিয়া থানায় একটি জিড়ি করেন যার নম্বর-১২৯৬। উক্ত জিড়িতে তিনি উল্লেক করেন তার স্বামী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুর আহমদের নামে ইস্যুকৃত মুক্তিভাতা উত্তোলনের পাস বইটি হারিয়ে গেছে। জিডিমুলে তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেন। উক্ত জিডি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ছফুরা খাতুন ১৫/০৩/১৭ইং তারিখে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরে তার স্বামীর বন্ধ রাখা সম্মানী ভাতা পুনরায় চালু করার জন্য আবেদন করেন।

উক্ত আবেদনপত্রে সুপারিশ করেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর ডেপুটি কমান্ডার মিলন কুমার ভট্টাচায্য। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরেও তার স্বামীর ভাতা পুনরায় চালু করা হয়নি। অভাবের তাড়নায় আত্বসম্মানবোধ ত্যাগ করে বীর মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী ছফুরা খাতুন অন্যের বাড়িতে ঝি’এর কাজ করে জীবন কাটাচ্ছেন। জানা গেছে, স্বামীর ভাতা পুনরায় চালু করার জন্য রাজনৈতিক নেতা থেকে সরকারী কর্মকর্তা পর্যন্ত সবার দ্ধারে দ্ধারে  ঘুরেছেন তিনি। কারও কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও কেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুর আহমদের ভাতা চালু হচ্ছে না তার কোন সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

এক সময়ের জামায়াত অধ্যুষিত জনপদ সাতকানিয়ায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুর আহমদের মত অনেক মুক্তিযোদ্ধাই চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সহযোগিতা মিলছে না জনপ্রতিনিধিদের কাছে। রাজনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। দরিদ্র ছফুরা খাতুন জানেন না জীবদ্দশায় তার স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পুনরায় চালু করা যাবে কি না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন কেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারে অমানিশার অন্ধকার। এ প্রশ্ন বৃদ্ধ স্বামীহারা ছফুরা খাতুনের।

এ রকম অনেক ছফুরা খাতুনের জীবন যন্ত্রনার উপাখ্যান রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। কয়জন তার খবর রাখেন। বর্তমান সরকারকে বলা হয় মুক্তিযোদ্ধা বান্ধব সরকার। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পবিরার পরিজনের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে সর্বমহলে। তবে এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে কোথায় প্রতিবন্ধকতা, কেন আবেদন করার একবছর পরও ছফুরা খাতুনরা সন্তোষজনক জবাব পাবেন না তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। প্রতি বছর বিজয়ের মাস, স্বাধীনতার মাস আসলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোকজনকে ডেকে হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি ক্রেষ্ট। সারা বছর তাদের কথা কেউ মনে রাখেন না।

গত ডিসেম্বরেও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কে একটি ফুলের তোড়া ও চারশ টাকার প্রাইজবন্ড দেওয়া হয়। এটাই কি মুক্তিযোদ্ধাদের মুল্যায়ন। এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? অভিযোগ আছে. এখনও মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে হাসপাতালে চিকিৎসা ও বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় ভর্তি হলে ভাগ্যে জোটে হাসপাতালের বারান্দা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসীন জিয়া-এরশাদ সামরিক জান্তা সরকার ও তাদের সৃষ্ট ক্যান্টনমেন্টকেন্দ্রিক সরকারগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থানকারী হানাদার বাহিনীর দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর গনধিকৃত নেতাদের মন্ত্রী, এমপি, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিল।

ওই সময় মুলত অনাদর, অবহেলা ও অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। অনেকে মরেছে বিনা চিকিৎসায়, অভুক্ত অবস্থায়। লজ্বায়, ঘৃনায় মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দেননি কেউ কেউ। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের দোয়ায় ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর মুল্যায়ন শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মাঝখানে বিএনপি-জামাত জোট আমলে ফের নেমে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবহেলা।

অবশেষে ২০০৮ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসলে পুরোদমে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে সুযোগ সুবিধা প্রদান। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনিদেরও আনা হয় সুযোগ সুবিধার আওতায়। কিন্তু সব মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার এসব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন কি না তা দেখা প্রয়োজন। সরকারের সব তালিকায় নাম থাকার পরও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুর আহমদের বিধবা স্ত্রী ছফুরা খাতুন কেন অন্যের বাড়িতে ঝি’এর কাজ করবে?

তার দরিদ্র পরিবারে কখন জ্বলে উঠবে আশার আলো? কতদিন আর অপেক্ষার প্রহর গুনবেন তিনি। বিষয়টি কি খতিয়ে দেখবেন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী কিংবা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। অসহায় বৃদ্ধা ছফুরা খাতুন একবুক আশায় প্রত্যাশার প্রহর গুনছেন। ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিভাবক, সুহৃদ ও শুভাকাঙ্খী। তিনি উল্লেখিত দাবীগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন বলে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসুরী সন্তানরা দৃঢ়ভাবে আস্থা ও বিশ্বাস রাখেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.