রামগড় বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

0

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ির রামগড় বিদ্যুৎ বিতরন কেন্দ্রের আবাসিক প্রকৌশলী (আর ই ) মো. মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম , দুর্নীতি ও বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা যায়, দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ধরে একই কর্মস্থলে চাকুরির সুবাধে দুর্নীতির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ ছাড়া এখানে কোন কাজই হয়না। সব অনিয়ম, দুর্নীতি যেন এই কার্যালয়ে নিয়মে পরিনত হয়েছে। আর ই’র স্বেচ্ছাচারী আচরণ এখন মানুষের মুখে মুখে। প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের সঙ্গে গাল-মন্দ ও বাক- বিতন্ডা লেগেই আছে। অবলিলায় নানা অপকর্ম করলেও দেখা বা বলার কেউ নেই। অবশ্য এ অশুভ কর্মকান্ডের জন্য বিদ্যুৎ গ্রাহকদের নিকট ইতিমধ্যেই ধিক্কৃত ব্যক্তি হিসাবে চিহিৃত তিনি। তারপরও বোধোদয় নেই। সবকিছু গা-সওয়া হয়ে গেছে তার।

রামগড় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল কাদের, প্রেসক্লাব সাধারন সম্পাদক বেলাল হোসাইন ও কোষাধ্যক্ষ শুভাশীষ দাশ বলেন, তার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের হাজারো অভিযোগ। ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং আর ই এখন যেন একটি সমার্থক বিষয়। উপজেলা সমন্বয় কমিটির বৈঠকেও বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য তাকে একাধিক বার তিরস্কার করা হয় কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। গ্রাহকদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়া তার স্বভাব। গতবছর দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) এর একটি বৈঠকে রামগড় টাউন হলে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি সমস্বরে তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ উত্থাপন করেন। দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির উপজেলা সভাপতি মো. শাহ আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। রামগড় বাজারের পোল্ট্রী ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহীম বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের মতো এত অব্যবস্থাপনা রামগড়ে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে নেই। তিনিসহ অন্যান্যদের মতে, এ সবকিছুর মূলে আবাসিক প্রকৌশলী মোস্তফা কামাল। পৌর কাউন্সিলর আবুল কাসেম বলেন, তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ। নিয়ম কানুনের বালাই নেই, যা ইচ্ছে তা-ই করছে সে। দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির মো. শাহ আলম বলেন, বিদ্যুৎ লাইনের ওপর ঝুঁিকপূর্ণ গাছ কাটতে বললে আর ই (আবাসিক প্রকৌশলী) টাকা দিতে বলেন আমাকে! গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত মামলার ভয় দেখায়। সম্প্রতি সোনাইপুল বাজারের মো. কামরুল এই প্রতিনিধিকে জানান, তার নির্মিয়মান তিনতলা ভবনের প্রথম তলার ওপর দিয়ে জোর করে বিদ্যুতের লাইন সম্প্রসারণ করে। জানতে চাইলে, আর ই সাফ জানিয়ে দেয় টাকা পেলে লাইন সরিয়ে দেব।

সম্প্রতি এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক অনুসন্ধানে তার সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দুর্নীতি করে প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন, গ্রাহক হয়রানি ও দুর্ব্যবহার এমন কি তার কার্যালয়ের অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে অহিনকুল-সম্বন্ধ। অধিকাংশ কর্মচারীই সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে গোপনে অসন্তোস প্রকাশ করেছেন। তার জন্য গ্রাহকদের কাছে সবসময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় বলে কর্মচারীরা উল্লেখ করেন। সোহেল নামে এক কর্মচারী প্রতিবাদ করায় তাকে তাৎক্ষনিক বদলি করা হয়। গর্জনতলী গ্রামের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক মো.খোরশেদ আলম ও জগন্নাথ পাড়ার সুনীল দেবনাথ এই প্রতিবেদককে জানান, সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিল, লাইন ও মিটার সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আবাসিক প্রকৌশলী মোস্তফা কামাল চরম দুর্ব্যবহার করে এবং কার্যালয় থেকে বেড়িয়ে যেতে বলে তাঁদের। সুনীল দেবনাথ আরও বলেন, তাকে পরে ডেকে বলা হয় সমস্যা সমাধানে গ্রাহক প্রতি এক হাজার টাকা করে লাগবে। সোনাইপুল গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক ইউনুছ জানান, টাকা খেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন ট্রান্সফরমারে ওভার লোডিং লাইন সংযোগ দেওয়ায় লো ভোল্টেজে নাকাল হচ্ছে গ্রামের বাসিন্দারা।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যাটারী চালিত তিন চাকার গাড়ি টম টম বানিজ্যিকের পরিবর্তে আবাসিক মিটারে চার্জ সুযোগ দিয়ে অবৈধ আয় করা, লাইন সম্প্রসারণ( প্রতি খুঁিট বিশ হাজার টাকা ) ও সুবিধাজনক স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি বসিয়ে দেওয়ার নামে গ্রাহকদের থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্বসাৎ, লাইন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসিক বরাদ্ধের টাকা কাজ না করে হাতিয়ে নেওয়ায় সামান্য বাতাস বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, করাত কল, রাইচ মিল ও ওয়ার্কশপ ( দুএকটি ছাড়া সব কয়টি এনালগ মিটার) থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা আদায়,বৈদ্যুতিক খুঁিটতে ডিস লাইনের সুযোগ দিয়ে বাড়তি সুবিধা ভোগসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। লাইন সম্প্রসারণের জন্য লামকু পাড়ার হোসেন মেম্বার ও তৈচালার ওবায়দুল হক মোটা অঙ্কের ঘুষ দেওয়ার বিষয় সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন। ওবায়দুল হক বলেন, প্রতি খুঁিট দশ হাজার টাকা করে দিয়েছি কিন্তু পুরো এক বছর পেরিয়ে গেলেও লাইন পাইনি। বল্টুরাম গ্রামের শ্যামল ত্রিপুরা বলেন, তার এলাকায় বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারনের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়ায় অগ্রীম দশ হাজার দিই কিন্তু জানাজানি হয়ে গেলে পরে টাকা ফেরত দেন আর ই। নতুন মিটার বসাতে গ্রাহকদের হয়রানির সীমা থাকে না। ছয়শ টাকার মিটার তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অবৈধভাবে আদায় করে। আর এ সবের নাটের গুরু স্বয়ং আবাসিক প্রকৌশলী (আর ই ) মো. মোস্তফা কামাল ও প্রধান করণিক সুনীল মজুমদার। ২১, নভেম্বর ’১৭ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অমল নাথ লিখিতভাবে জানিয়েছেন, পনের হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে আর ই অন্যের সুবিধার জন্য একটি বিদ্যুতের খুঁিট জোর করে তার বসতভিটায় বসিয়ে বিপদের মধ্যে ফেলেছেন তাকে।

সরেজমিন আরও জানা যায়, পিডিবির জায়গায় অবৈধভাবে মার্কেট নিমার্ণ করায় পাওয়ার ষ্টেশনের সাব-সেন্টারটি এখন অত্যন্ত ঝুঁিকপূর্ণ। সূত্র জানায়, আগে সীমিত আকারে দুএকটি দোকান ছিল কিন্তু আর ই গত এক যুগেরও বেশি সময় এখানে অবস্থান করে ক্রমান্বয়ে পাকা মার্কেট তৈরি করে পিডিবি’র উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া। মোটা অঙ্কের সেলামী নিয়ে ইতিমধ্যে দোকান ঘরগুলো ভাড়াও দেওয়া হয়েছে। এ বানিজ্যিক প্লটগুলোর আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশেও গড়মিল রয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, পাওয়ার ষ্টেশন সংলগ্ন জমিতে অবৈধ ভাবে মার্কেট নিমার্ণ করায় ভেতরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থানে মানুষ সহজে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে। যে-টা বিদ্যুতের মতো অতি সংবেদনশীল বিষয়ের বেলায় কোন ভাবেই সঠিক বলা যায় না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের জনৈক কর্মচারী জানান, সর্বোচ্চ একশ ফুট পর্যন্ত দুরুত্বে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যেতে পারে কিন্তু বাস্তবে রামগড়ে বৈদ্যুতিক খুঁিট ছাড়া অবৈধ লেনদেন এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি স্থানে জীবন্ত গাছে তার বেঁেধ ডাল-পালার ভেতর দিয়ে এক-দেড় কিলোমিটার দুরুত্বে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ,সামান্য বাতাসে তার ছিঁড়ে কিংবা ঝুলে পড়ে বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
দুর্নীতির আরও ধরন হচ্ছে, আপদকালীন সময়ের জন্য মজুদ দুটি ট্রান্সফরমার অর্থের বিনিময়ে গোপনে প্রাইম ব্যাংক ও নাইটেংঙ্গেল ডায়গনষ্টিক সেন্টারকে দিয়েছে সে। প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ীর মিটার টে¤পারিং করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে মোস্তফা কামাল ও সহযোগী সুনীল মজুমদার। ফলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের আবর্তে প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এক কর্মস্থলে থাকার নিয়ম কিন্তু আর ই মোস্তফা কামাল ২৫, জানুয়ারী ২০০৫ সাল থেকে অদ্যাবধি রামগড় চাকুরি করছেন। আয় রোজগার ভালো বলে উপরে ঘুষ দিয়ে দীর্ঘ সময় এখানে আছেন। এক যুগেরও বেশি সময় রামগড়ে অবস্থানের সুবাধে নামে বেনামে জেলার সবুজবাগে দামী জমি, রামগড় মাস্টারপাড়া ও নাকাপা এলাকায় বসতজমি এবং বনজ-ফলদ বাগান এবং ঢাকার ফতুল্লায় ৮ তলা বাড়ীসহ অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন মোস্তফা কামাল। অন্যদিকে, সহযোগী সুনীল মজুমদার রামগড় বাজারে বানিজ্যিক প্লট (২০লাখ), জগন্নাথ পাড়ায় জমি এবং নাকাপায় বনজ-ফলদ বাগানসহ প্রচুর ব্যাংক ব্যালেন্স হয়েছে তার।

উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্রগ্রামে স্থায়ী নাগরিক ছাড়া জমি ক্রয় করতে পারেন না। সূত্র জানায়, গ্রাহকদের ডিজিটাল মিটার বসাতে বললেও নিজ কার্যালয় ও ষ্টাফ কোর্য়াটারে রয়েছে সব এনালগ মিটার। অফিস ও স্টাফদের কোর্য়াটারে ব্যবহারের জন্য দৈনিক চার হাজার লিটার পানি উত্তোলন করেন দুটি মিটার বিহীন বৈদ্যুতিক মটর দিয়ে। যেগুলোর সংযোগ রয়েছে সাধারণ গ্রাহকদের লাইনে। প্রতিদিন পানি উত্তোলন বাবদ প্রায় পাঁচ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। যা বছরে দাঁড়ায় আঠারশ ইউনিট। এই ইউনিট মূল্য অজান্তেই পরিশোধ করেন সাধারণ গ্রাহকেরা। আবাসিক প্রকৌশলীর জন্য বরাদ্ধ থাকার পরও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাশের অন্যটিসহ দুটি বাসা ব্যবহার করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী দশ শতাংশ বাসা ভাড়া আইন তিনি মানছেন না। মিটার রিডার পদে দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে চার জনের স্থলে তিন কর্মচারী নিয়োগ দেন। কিন্তু নিয়োগের পর কর্মচারীদের বেতন রেজিষ্টারে কাগজে কলমে বেতন তুলেন চারজন। সুবল দত্ত পিতা শংকর দত্ত সাং গর্জনতলী এই নামে বেতন উত্তোলন হলেও খোঁজ নিয়ে কাউকে কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রামগড় আবাসিক প্রকৌশলী মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের কাছে জমি কেনার কথা স্বীকার করেন তবে অন্যান্য বিষয়ে কোন সদোত্তর দিতে পারেন নি। সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, তার বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রে গেলে উপঢৌকন দিয়ে তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে আর ই। জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি বিদ্যুৎ বিভাগের নিবার্হী প্রকৌশলী আবু জাফর বলেন, দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকলে একটু এদিক-ওদিক তো হবেই। পাহাড়ে চাকুরি করতে কেউ চায় না! না হয় তাকে বদলে দিতাম বলে মন্তব্য করেন আবু জাফর। আর ই’র বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার কথাও জানান তিনি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.