শিপ ব্রেকিঙ ইয়ার্ডঃ ৫ বছরে নিহত ৯৩ আহত ১৫৪ শ্রমিক

0

কামরুল ইসলাম দুলু, সীতাকুন্ডঃ  চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্প (শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড) এ শিল্পের সঙ্গে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের মতে, এ শিল্পটি শ্রমিকদের জন্য মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।

একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন প্রকার দূর্ঘনায় গত ৫ বছরে ৯৩ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ১৫৪ জন শ্রমিক। গত মঙ্গলবার এক বছরে ইয়ার্ড শ্রমিক হতাহতের তথ্য সংগ্রহ করে এ সংখ্যা জানিয়েছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা “ওশি ফাউন্ডেশন” নামের একটি এনজিও।
সংস্থাটি তাদের নিজস্ব তথ্য সংগ্রহকারী এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওশি’র মিডিয়া কর্মকর্তা আবদুর রশিদ। জানা যায়, দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়া, লোহার প্লেটের ধাক্কা বা নিচে চাপা পড়া, অগ্নিকান্ডে, স্কেভেটরের আঘাত এবং বিষাক্ত গ্যাসে আটকা পড়া।

জাহাজ ভাঙ্গা ইয়ার্ডে শ্রমিকদের হতাহতের পেছনে রাতের বেলায় কাজ করা, সেফটি প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রমিক নিযুক্ত করা, শ্রম আইন ও বিধিমালার অপর্যাপ্ত প্রয়োগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অপর্যাপ্ত পরিদর্শন ব্যবস্থা অভাবকে দায়ী করা হয়।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙ্গা পাত বহন করছে
                             জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙ্গা পাত বহন করছে

প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্র অনুযায়ী প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ ইয়ার্ড তাদের শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ- হেলমেট, সেইফটি জ্যাকেট, বুট ইত্যাদি সরবরাহ করেন না। অন্যদিকে যেসব ইয়ার্ডে এসব উপকরণ দেয়া হয় অনেক শ্রমিকরা এসব ব্যবহারে উদাসীন।

আরো জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম এই জাহাজ ভাঙা শিল্পে প্রায় ১০০টি ইয়ার্ডে কাজ করছে ২২ হাজার শ্রমিক, পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে আরও ১০ হাজার জন। উন্মুক্ত সৈকতে ঝুঁকিপূর্ণ বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজ কাটতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন অতি দরিদ্র এসব শ্রমিক।

২০১৫ সালের বাংলাদেশ শ্রম বিধি মালায় মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে সেইফটি কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা করা হয়। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোশিয়েশন (বিএসবিএ) সহকারী সচিব নজমুল ইসলাম জানান, শিপ ইয়ার্ডে দূর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের বেশির ভাগই মারা গেছে মোবাইলে কথা বলার কারণে।

শ্রমিকরা কাজ করার সময় মোবাইলে কথা বলতে বলতে দূর্ঘটনায় পতিত হয়। এছাড়া প্রতিটি ইয়ার্ডে শ্রমিক সুরক্ষা উপকরণ দেয়া হলেও শ্রমিকরা তা যথাযথ ভাবে ব্যবহার না করার কারণেও দূর্ঘটনা ঘটে।

আর দূর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকরা শ্রমনীতিমালার আলোকে ক্ষতিপুরণসহ মালিকপক্ষ থেকেও অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হয়ে থাকে। যা অন্য কোন শিল্পে নেই। এ শিল্পে কাজ করা বেশিরভাগ শ্রমিক রংপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বগুড়া, বরিশাল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের।

সীতাকুন্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্প এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। একটু এদিক-সেদিক হলে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটে শ্রমিকদের। দিন দিন জাহাজ ভাঙা শ্রমিকের নিহতের তালিকা দীর্ঘ হলেও শ্রমিকদের অভিযোগ তাদের জীবন রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ নেই মালিক পক্ষের।

উল্লেখ্য যে, ১৯৬০ সালের প্রলয়ংকারি জলোচ্ছাসে গ্রীক জাহাজ এম ভি অলপাইন আটকে পড়ে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড সমদ্র উপকূলের ফৌজদারহাট এলাকায় দীর্ঘ কয়েক বছর আটকে থাকার পর ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম স্টিল মিলের কর্মীরা স্থানীয়দের সহযোগিতায় জাহাজটি ভাঙ্গা শুরু করে এবং পরবর্তিতে তা বিক্রি করে, এভাবেই মূলত জাহাজ ভাঙ্গার উৎপত্তি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি জাহাজ আল আব্বাস বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে চট্টগ্রামে আটকা পড়ে। সেই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত রাশিয়ান একটি দল জাহাজটিকে ফৌজদার হাট উপকূলে নিয়ে আসে।

পরবর্তীতে, ১৯৭৪ সালে কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কশপ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি জাহাজটি স্ক্র্যাপ হিসেবে কিনে নিয়ে কাটা শুরু করলে স্বাধীন বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের গোড়াপত্তন শুরু হয়।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.