সাতকানিয়া ট্র্যাজেডি: কান্নার মাতম থামছেনা

0

গোলাম শরীফ টিটু,সিটি নিউজ : ধন-সম্পদ, জশ-খ্যাতি কোনটার অভাব নেই তার। থাকা-উঠাবসা সমাজের উচ্চস্তরে। দান-খয়রাতও করেন। তিনি কেএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাতকানিয়া থানার ৩নং নলুয়া ইউনিয়নের পুর্ব গাটিয়াডাঙ্গা হাঙ্গরকুলের বাসিন্দা আলহাজ্ব মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি ঢাকঢ়োল পিটিয়ে এলাকার গরীব ও নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে জাকাত ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ করতে বার-বার উপহার দিচ্ছেন মানুষের লাশ। তবুও তার লোক দেখানো সাহায্য দেয়ার খায়েশ মেটেনি। প্রতিবারের মত গত ১৪ মে তার নিজস্ব উদ্যোগে নিজ বাড়িতে আসন্ন রমজান উপলক্ষে দুস্থদের মাঝে ইফতার সামগ্রী ও শাড়ি লুঙ্গি যাকাত বিতরণ শুরু করেন সকাল ৮ ঘটিকায়।

যাকাত গ্রহনের উদ্দেশ্যে সাতকানিয়া উপজেলা সহ পার্শ্ববর্তী থানা ও জেলা বান্দরবান, কক্সবাজার এলাকা থেকে আগেরদিন গভীর রাত থেকে আলহাজ্ব মোহাম্মদ শাহজাহানের বাড়ির বাইরে তার নিজস্ব মাদ্রাসা ও মসজিদ মাঠে জমায়েত হতে থাকে। সকাল নাগাদ লোকসংখ্যা ৩৫-৪০ হাজারে দাঁড়ায়। যাকাত দেওয়া শুরু হলে মাঠের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে ধারণ ক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি নানা বয়সী নারীদের মাঝে অল্প সময়ের জন্য ঠেলা-ধাক্কার ঘটনা ঘটে। এর পর আগেরদিন থেকে নিদ্রাহীন অপেক্ষমান এই দুস্থ নারীদের অনেকেই সেখানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদেরকে স্বেচ্ছাসেবক দল মাঠ সংলগ্ন মাঠ মাদ্রাসার নিচ তলায় কেএসআরএম’র নিয়োজিত মেডিকেল টিমের নিকট পর্যায়ক্রমে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ৯ জনকে মৃত ঘোষনা করে।

কর্তব্যরত চিকিৎসকরা প্রাথমিক ধারনামতে প্রচন্ড রোদ ও ভিড়ের মধ্যে শ্বাসরোধ ও হিটস্ট্রোকে তাদের মৃত্যু হতে পারে।

এই ঘটনায় আরও ৫-৬ জন শ্বাস কষ্টে অসুস্থ হয়ে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন। নিহতরা হলেন-লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের মো: শফির স্ত্রী নুরজাহান (২২), একই এলাকার আবদুস ছালামের মেয়ে টুনটুনি বেগম (১৫), আবদুল করিমের স্ত্রী রহিমা বেগম (৪৫), আজম আলীর মেয়ে ফাতেমা বেগম (১৬), সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের নুর আহমদের স্ত্রী রশিদা আক্তার (৫০), একই উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের মোবারক হোসেনের মেয়ে সাকি আকতার (২৪), একই এলাকার হাসান ড্রাইভারের স্ত্রী রীনা বেগম (৪০), মোহাম্মদ ইসলামের স্ত্রী হাসিনা আকতার (৪০), বান্দরবান জেলার সুয়ালক এলাকার কায়েস আলীর স্ত্রী নুর আয়েশা বেগম (৪০) ও আবদুল হাফেজের স্ত্রী জোস্না বেগম (৪৫)। নিহত জো¯œা বেগমের কোন স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া যায়নি। পদদলিত হয়ে আহতদের মধ্যে যাদের নাম যাওয়া গেছে তারা হলেন, মোস্তফা খাতুন (৬০), নুর আয়েশা (৫০), হোসনে আরা বেগম(৪৫), জুনু মিয়া (৪০), রাজিয়া বেগম (৫৫), রোকেয়া বেগম (৩৫), দিলুয়ারা বেগম (৪০) ও মোহাম্মদ সাকিব (১২)।

একই ব্যক্তির বাড়িতে যাকাতের পন্য নিতে গিয়ে ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবরও প্রাণ হারান ৮ জন নারী পুরুষ। সে সময় অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছিলেন। উভয় ঘটনায় জাকাতের পন্য হিসেবে ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে একই বাড়িতে পদদলিত হয়ে মারা গেছে ১৮ জন। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২ শতাধিক নারী ও শিশু। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, প্রতি বছর এলাকায় কেএসআরএম গ্রুপের মালিক আলহাজ্ব শাহজাহান এলাকার দুস্থদের মাঝে চাল, শাড়ি, নগদ টাকা সহ ইফতার সামগ্রী বিতরন করে থাকেন।

এবারও ইফতার সামগ্রী বিতরণের কথা শুনে মাদ্রাসা মাঠে আগেরদিন সন্ধ্যার পর থেকে দুস্থ লোকজন জড়ো হতে থাকে। সকালে মাঠে প্রায় ২০ হাজারের বেশি মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। এত লোকের সামনে মাঠের মধ্যে ওই দিন সকালে ইফতার সামগ্রী বিতরন শুরু হওয়ার সাথে সাথে হুড়োহুড়ি করে প্রবেশ করতে গিয়ে পদদলিত হয়’। ইসলামের দৃষ্টিতে দান করার বিধান প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জাতীয় মসজিদ জমিয়তুল ফালাহ’র খতিব আল্লামা আবু তালেক মুহাম্মদ আলাউদ্দিন আলকাদেরী বলেন,’ দান আল্লাহ’র ইবাদতের একটা অংশ।

দান অপ্রকাশ্যে করাটাই উত্তম। প্রকাশ্যে দানেও অসুবিধা নেই। কেননা এতে অন্যরা উৎসাহিত হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজে অসহায় ও গরীব লোকদের প্রকাশ্যে যেভাবে যাকাত, ফিতরা কিংবা ইফতার সামগ্রী দান করা হচ্ছে তাতে সেটা ইবাদত হিসেবে গন্য হয় না। এর কারন হলো, যারা প্রকাশ্যে দান করছেন সেখানে তাদের ব্যক্তি প্রচারনাটাই মুখ্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি তাদের মুখ্য বিষয় না’। বর্তমানে অনেকে নাম, খ্যাতি ও প্রচারনার জন্য দানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে উল্লেখ করে আল্লামা আবুু তালেব বলেন,’নিজ হাতে দান করাটা সবচেয়ে উত্তম।

কিন্তু এখন অনেকে নিজে দান না করে অন্যদের মাধ্যমে দান করছেন এবং সেখানে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। আর এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার দায়ভার দানকারী ব্যক্তির উপর বর্তাবে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিরা জানান,’এত বিশাল সংখ্যক লোকের আয়োজনের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব ছিল। সারিবদ্ধভাবে লোকজনের মধ্যে ইফতার সামগ্রী বিতরনের কোন ব্যবস্থা ছিল না।

এ কারনেই ঘটে প্রানহানীর ঘটনা। আগেরদিন রাত থেকে জড়ো হওয়া লোকজনকে ইফতার সামগ্রী দিয়ে দিলে মানুষের জটলা কমতো। কিন্তু লোকদেখানো ভাবে দিনের আলোতে দিতে গিয়ে এ ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর একইভাবে ইফতার সামগ্রী বিতরন করতে গিয়ে ৮ জনের মৃত্যুর পর আবার কেন একই পন্থায় ইফতার বিতরন করা হল? এ প্রশ্নের জবাব মিলেছে এলাকাবাসীর কাছে। তাদের মতে, ২০০৫ সালের প্রানহারীর ঘটনার পর এলাকার দুস্থদের তালিকা করে তাদের নামে কার্ড করে দেয়া হতো। সেই কার্ডের মালিকরা এসে অথবা কার্ড নিয়ে কেউ এসে ইফতার সামগ্রী নিয়ে যেতে পারতো।

এ ছাড়া একদিনে সব ইফতার সামগ্রী বিতরন করাটাও ছিল তাদের ভুল সিদ্ধান্ত। তাদের মতে,’ এই মৃত্যুর মিছিল তাদের অহঙ্কবোধ, লোকদেখানো বড়লোকি ও সাতকানিয়া উপজেলার আগামী দিনের রাজনীতিতে অবস্থানের চেষ্টার কারনে ঘটেছে। কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা ও খাময়োলীপনার কারনে কিছু চাল-ডাল, কিছু ছোলা বা একটা যাকাতের শাড়ির আশায় যাওয়া হতদরিদ্র ১০ টা মানুষ তাদের প্রান নিয়ে ফিরে আসতে পারেনি। মানুষের হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে তারা চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

জানা যায়, কেএসআরএম গ্রুপ প্রতিবছর এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটা করে যাকাত শাড়ি ও ইফতার সামগ্রী বিতরন করেন। দানের সামগ্রীর মধ্যে থাকে চাল ৩ কেজি, ডাল ১ কেজি, ছোলা ২ কেজি, শাডি ১টি, আধালিটার সোয়াবিন তেল ও নগদ ১ হাজার টাকা। চাল চুলাহীন দরিদ্র মানুষদের কাছে এ খবর পোঁছালে তারা এ দান সামগ্রীর আশায় ছুটে আসে দুর দুরান্ত থেকে। সাতকানিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও চন্দনাইশ, বাঁশখালী, চকরিয়া, পটিয়া প্রভৃতি জায়গা থেকেও দরিদ্র মানুষের স্রোত মিলিত হয় সাতকানিয়ায়।

উপচেপড়া মানবস্রোত সামলানোর উদাসীনতার কারনে এর আগেও একবার ২০০১ সালে একই ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। বার-বার ঘটে প্রাণহানী, গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। দোষ চাপে নিরহ কর্মচারীদের উপর। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। যে দান মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, সেই দানের দরকার কি! সাহায্য বিতরণের নামে আর কতকাল কেএসআরএম এর মালিক শাহজাহান দুস্থ মানুষদের লাশের উপর নোংরা রাজনীতি করবেন? এই প্রশ্ন এখন এলাকাবাসীর।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.