চট্টগ্রামে এমপিদের খায়েশ ও তৃনমূলের বিরোধ

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটি নিউজ: সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৩ মাস রয়েছে। গুরুত্বপুর্ন এই সময়ে এমপিদের সঙ্গে তৃনমুল নেতাকর্মী ও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দুরত্ব, দ্বন্দ্ব ও বিরোধের ঘটনা ঘটছে চট্টগ্রামে। এখানে দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মুল্যহীন। চট্টগ্রামের সব আসন এলাকার একই চিত্র। কর্মীদের মুল্যায়ন নেই। আত্বীয়করন আর ব্যক্তিকরন নিয়েই ব্যস্ত এমপিরা। দলের নেতাকর্মীদের পরিবর্তে হাই্ব্রীড ও বিএনপি-জামাত সহ সুবিধাবাদীদের প্রাধান্য বেশি এমপিদের কাছে। এমপিদের সব সময় ঘিরে রাখে নির্দিষ্ট চামচা-চাটুকাররা।

এর ফলে তৃনমুল নেতাকর্মীদের সাথে এমপিদের দুরত্ব বাড়ছে। ক্ষুদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে অনেকের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও পত্রিকায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন। অনেকের বিরুদ্ধে সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে তৃনমুল। অনেক এমপি দলের নেতাকর্মীদের চাপে রাখতে বিএনপি-জামাতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তৃনমুল নেতাদের অনেকেই এবার সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। এতে করে প্রায় সব আসনে এমপিদের সাথে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দুই বারের অটোপাস এমপিগন আবারও মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশায় দলীয় হাইকমান্ডকে তদবির ও নানা অনুষ্টানসুচি সারা বছর না করলেও এখন করছেন। নগরীতে কোন কোন এমপি কাউন্সিলরদের নিয়ে বলয় সৃষ্টি করে গনসংযোগ ও প্রচারনা চালাচ্ছেন। বেশিরভাগ চসিকের কাউন্সিলর এমপিদের সান্নিধ্যে কাজ করছেন। বিগত দিনে এরা নানা ভাবে এমপির দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। এমপিদের দান খয়রাতের সামগ্রী ও অর্থ তারা নিজেদের বলেও চালিয়েছেন ঈদ-পার্বনে।
চট্টগ্রামে অনেক এলাকায় এমপিদের সাথে স্থানীয় নেতাকর্মীদের দুরত্ব সম্পর্কে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বলছে, মাঠপর্যায়ে ছোটখাট যে সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। মনোনয়ন যে কোন নেতা চাইতেই পারেন। এটা তার রাজনৈতিক অধিকার। দল সিদ্ধান্ত নেবে, কাকে মনোনয়ন দেবে। দলীয় সিদ্ধান্তই হবে চুড়ান্ত। তৃনমুলের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপিদের সঙ্গে দুরত্ব সবচেয়ে বেশি বাড়ছে তৃনমুলের। দলীয় নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে চলছেন তারা। তাদের অনেক দম্ভ। নেতাকর্মীরা কোন কাছে এমপিদের কাছে গেলে চরম দুর্ব্যবহার করেন এমন অভিযোগও রয়েছে।

তারা বলে থাকেন, কেউ কি ভোট দিয়ে এমপি করেছেন? নেত্রী মনোনয়ন দিয়েছে তাই এমপি হয়েছি। মনোনীত তাই নির্বাচিত এ রকম অর্ধশত এমপি সারাদেশে নির্বাচনের পর নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। নেতাকর্মীদের সাঙ্গে যোগাযোগও তারা কমিয়ে দেন। মফস্বলের অনেক এমপি থাকেন চট্টগ্রাম জেলা শহরে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার এলাকায় নিমন্ত্রন, সভা, সমাবেশ বা দেখা সাক্ষাতে যান। সরকারী কর্মসুচীতে থাকলেও দেরী না করে বিমানবন্দর ছুটেন ঢাকায় যেতে। অনেক এমপিদের দলীয় কর্মসুচীতেও অনুপস্থিত দেখা যায়। তারা রাজনীতি ড্রয়িং রুমে বসে করেন। জনগনের সাথে সম্পৃক্ততা নেই-এমন এমপির সংখ্যাই বেশি চট্টগ্রামে।

এভাবে গত সাড়ে ন’বছরে অটোপাস এমপিদের সাথে অনেক আসনে তৃনমুলের দুরত্ব এখন মারাত্বক আকার ধারন করেছে। তৃনমুলের নেতাকর্মী ও শুভার্থীদের মোবাইলও অনেক এমপি রিসিভ করেন না। কেউ কেউ এলাকায় নেতাকর্মীদের পছন্দ না হওয়াতে বা অন্য কোন নেতার অস্থাভাজন হওয়াতে দমন-পীড়ন ও শারিরীক নির্যাতনও করেছেন। এই দুরত্ব এখন গুছাবার সময় নেই। আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনী ট্রেনে। তবে কোন কোন ট্রেনের বগিতে আছে দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদীরা। এদেরকে এখন মুখোমুখি হতে হচ্ছে নবাগত মনোনয়ন প্রত্যাশীদের। এতে করে ক্ষুদ্ধ হয়ে সম্রাজ্য ধরে রাখার প্রত্যয়ে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে রেখেছেন কোন কোন এমপি। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে অভিযুক্ত সংসদ সদস্যরা ততই এলাকামুখী হতে গিয়ে স্থানীয়ভাবে বিরোধীতার মুখে পড়ছেন।

বেশিরভাগ আসনে কোন মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সহ্য করতে পারছেন না এমপিরা। চট্টগ্রাম জেলার প্রত্যেক আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী চার-পাঁচজন। দলের ত্যাগী ও শীর্ষ পর্যায়ের বা সাবেক এমপিরা মনোনয়ন চাইতেই পারেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এমপির অনুসারীরাও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বাঁধা প্রদান, নির্যাতন, পুলিশ দিয়ে বাধা সহ ননাবিধ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না এমপিরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিদের। এতে করে দলীয় বিভক্তিও বাড়ছে। যার প্রভাব পড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতায় মানুষ দীর্ঘদিন যাবত দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। আগ্রাবাদ ও হালিশহর এলাকায় জোয়ারের পানির কারনে নীচতলার কোন বাসিন্দা বসবাস করতে পারছেন না। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বেপারী পাড়া সহ বিস্তীর্ন জনপদ থাকে জোয়ারের পানিতে নিমর্জ্জিত বছরের অর্থেকেরও বেশি সময়। রাস্তা উঁচু করলেও পানিতে ডুবে থাকে। মহেষখালের মুখে স্যুইচ গেইট করার কথা থাকলেও কোন সাড়া নেই। জনপ্রতিনিধিরা ভোট আসলে সরব হন। মানুষের দুর্গতিতে তাদের যেন ভুমিকা নেই।

মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সমস্যা সমাধানের কোন আশ্বাস না দিয়ে মনোনয়নের দৌড়ে আছেন। আওয়ামী লীগের কোন কোন সংসদীয় আসনে এমপিদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বি নেই প্রকাশ্যে। এমপিদের রাজত্ব চলছে বিনাবাধায়। কেউ প্রতিবাদ করলেই হয়রানীর শিকার অথবা এলাকাছাড়া হতে হয়। বিগত সাড়ে নয় বছরের শাসনামলে এলাকাবাসী অনেক এমপির দেখা পেয়েছেন খুব অল্প সময়ে। এ ছাড়া এলাকায় গেলেও চামচা চাটুকারদের দ্বারা বেশিরভাগ এমপি পরিবেষ্টিত থাকতেন।

চট্টগ্রামের মানুষ ভাল নেই। উন্নয়নের নামে খোড়াখুড়ির যন্ত্রনা, আত্বীয়করন, কোন্দল সৃষ্টি, বিভেদ সৃষ্টি সহ নানা কর্মকান্ডে বেশিরভাগ এমপির আমলনামা। জনগনের সাথে বিচ্ছিন্ন বেশিরভাগ এমপি। তবে এর মধ্যে অনেক এমপি প্রতি সপ্তাহে এলাকায় গিয়ে নেতাকর্মীদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করা ছাড়াও দলীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করছেন। দান খয়রাত ও ত্রান সামগ্রী বিতরনও করছেন।

নগরীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যানজট নিরসন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন সহ কোন কর্মকান্ডে এমপিদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। পর পর দুবার এমপি থাকায় অনেক এমপির গাছাড়াভাব ও শৈতল্যভাব দলীয় কর্মকান্ডকে যেভাবে ব্যাহত করছে যেভাবে মানুষও বিরক্ত সরকারের উপর-এতে করে সরকারের ভাবমুর্তিও বিনষ্ট হচ্ছে। বিগত দিনে মহানগরীতে উন্নয়নের যা কাজ হয়েছে তার বেশিরভাগ সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন করেছেন।

সংসদ সদস্যগন জলাবদ্ধতা ও জোয়ারের পানি বন্ধ করে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী গড়তে কোন সহায়তা গ্রহন করেননি। কোন কোন এলাকায় এমপিদের নিজস্ব সমর্থক গোষ্টী রামরাজত্ব কায়েম ও বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রত্যেক সংসদীয় আসনে এমপিদের বিপরীতে একাধিক গ্রুপ সক্রিয় থাকায় কোন কোন এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও সংঘটিত হচ্ছে। এমনকি জাতীয় ও দলীয় কর্মসুচীও পৃথক পৃথকভাবে পালন করা হচ্ছে। এই বিভেদ, বিভক্তি, গ্রুপিং রাজনীতি দল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে।

মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যেও কিছু মৌসুমী নেতার ছড়াছড়ি। সারাবছর চট্টগ্রাম মহানগর বা ঢাকায় বসবাস করলেও এখন নির্বাচনের সময় এলাকাবাসীর জন্য মায়াকান্না যেন উপছে পড়ছে। টাকা, দান, খয়রাত, সরকারের উন্নয়নের পোস্টার, ব্যানার এলাকায় সেঁটেছেন। জোয়ারের পানি ও জলাবদ্ধ নগরীতে জনগনের কাছে মনে হচ্ছে, ’ এ যেন কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা’। মানুষের দুর্ভোগ-দুর্গতিকে ওরা যেন ব্যঙ্গ করছে। আওয়ামী লীগ যেন আপন ঘরে পরবাসী শুধু তৃনমুলের ক্ষেত্রে ।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.