অমর একুশ মাতৃভাষা দিবস,মায়ের ভাষার গান

0

লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই : অমর একুশ মাতৃভাষা দিবস স্মরণে ভাষার মাসে মায়ের ভাষার গান ।মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার জন্য ঢাকার রাজপথে রক্ত দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, অহিদসহ আরো কত তাজা প্রাণ। পৃথিবীতে মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার জন্য আমরাই জীবন উৎসর্গ করতে পেরেছি। এ জন্য বাঙালির সম্মান সমগ্র বিশ্বব্যাপী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অমর একুশ এখন সমগ্র পৃথিবীব্যাপী পালিত হয় ‘একুশে ফেব্র“য়ারি’। ঐদিন সমগ্র পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাষ্ট্রীয়ভাবে উড়ানো হয় পতাকা ও অমর একুশের সংগীত। একুশে মাতৃভাষার উপর কালজয়ী সংগীত রচনা করে আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকরা নন্দিত হয়েছেন। ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতৃভাষা বাংলার জন্য রচিত গানগুলো কালজয়ী। তেমনি তিনটি কালজয়ী গানের অংশবিশেষ এই প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার প্রত্যয়ে এই প্রবন্ধে ভাষার মাসের মায়ের ভাষার গান শিরোনামে এই প্রবন্ধটি উপস্থাপিত হলো।
মাতৃভাষা বাংলার জন্য ইতিহাসে প্রথম কলম যুদ্ধ অবতীর্ণের সংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের কবিতায়। তাঁর কবিতার মাধ্যমে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য তিনি যুদ্ধ করেন। আজও তাঁর সেই কবিতা মাতৃভাষা বাংলাকে ভালোবাসা ও বাংলা রক্ষার জন্য প্রেরণা হয়ে আমাদের কাছে আছে। কবি আবদুল হাকিমের কবিতার এই অংশে মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ও যারা এই ভাষাকে বিদ্রুপ করেছিল তাদের প্রতি নিন্দা যেন এ কবিতায় ফুটে উঠেছে।

আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার অংশবিশেষ:

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

অমর একুশে স্মরণে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক, এই সময়ের আলোচিত বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী আবদুল গাফফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের সময় যাঁর বয়স ছিল ১৯, তিনি লিখেছিলেন আরেক কালজয়ী কবিতা। যেই কবিতা পরবর্তীতে কথা ও সুরে মাতৃভাষা আন্দোলনের জন্য অসাধারণ গানরূপে বাঙালি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। পরবর্তীতে এই সংগীত বাঙালি জাতির কাছে প্রাণের সংগীত হিসেবে হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান লাভ করে। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতা সর্বশ্রেণির কাছে এই সংগীতের কদর ও সম্মান রয়েছে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর সেই কালজয়ী

কবিতার অংশবিশেষ:
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্র“ ঝরা এ ফেব্র“য়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্র“য়ারি একুশে ফেব্র“য়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্র“য়ারি একুশে ফেব্র“য়ারি।।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্র“য়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্র“য়ারি
একুশে ফেব্র“য়ারি একুশে ফেব্র“য়ারি।।

অমর একুশ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ফজল-এ-খোদার রচিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ অসাধারণ এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আরেক বীরযোদ্ধা বাঙালির কৃতী সন্তান আবদুল জব্বার। এই গানটি শুধু ভাষা নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধেও বেশ প্রেরণা দিয়েছে। এই গানগুলো মানুষকে সত্য ও সাহসের জন্য পথ ঠিকানা নির্মাণ করে। কালজয়ী গানগুলোর মাধ্যমে মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে।

ফজল-এ-খোদার রচিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের অংশবিশেষ:
সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে,
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে
মায়ের ভাষায় কথা বলাতে
স্বাধীন আশায় পথ চলাতে
হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ
সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান
তাদের বিজয় মরণে,
ভাইয়ের বুকের রক্তে আজি
রক্ত মশাল জ্বলে দিকে দিকে
সংগ্রামী আজ মহাজনতা
কণ্ঠে তাদের নব বারতা
শহীদ ভাইয়ের স্মরণে,
বাংলাদেশের লাখো বাঙালি
জয়ের নেশায় আনে ফুলের ডালি
আলোর দেয়ালি ঘরে ঘরে জ্বালি
ঘুচিয়ে মনের আঁধার কালি।
শহীদ স্মৃতি বরণে,
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে।

ভাষার ইতিহাসে আরেক প্রতিবাদী কবিতার নাম ‘ওরা আমার মুখের ভাষার কাইরা নিতে চায়’। এই গানটি লিখেছিলেন আবদুল লতিফ। সুরও করেছেন তিনি। এই গানটি এপার বাংলা ওপার বাংলায় এখনো বিখ্যাত গান। ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য এই গানটির অবদান অবিস্মরণীয়। প্রজন্মকে মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগী ও শ্রদ্ধাশীল গড়ে তুলতে এই গানের ভূমিকা অপরিসীম।

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে
ওরা কথায় কথায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমাদেরই হাতে-পায়ে
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়
কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়
কও দেহি ভাই
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়।

আসুন আমরা সকলে মাতৃভাষাকে মর্যাদা দিতে এবং মায়ের প্রতি সম্মান জানাতে বাংলা চর্চায় যেন বর্তমান সমাজ বিপথগামিতায় না পড়ে সে জন্য মাতৃভাষার আন্দোলনের ঐতিহাসিক গানগুলো সংরক্ষণ এবং প্রজন্মকে শুনার জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করা আমাদের দায়িত্ব। মাতৃভাষা রক্ষার মাধ্যমে আমাদের মায়ের সম্মান ও মর্যাদাকে আমরা ধরে রাখব।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মরমী গবেষক।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.