মোবাইল ব্যাংকিং : ডিজিটাল অর্থনৈতিক বিপ্লব

0

মো. শাহেদুল ইসলাম : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যাংকিং এখন চার দেয়াল আর নির্দিষ্ট সময়ের গতিতে বন্দি নেই। মোবাইল ফোনের ব্যবহার আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবা লাভ করার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত অনলাইন বা ই-ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে ব্যাংকিং এর সুবিধা কয়েক বছর আগে শুরু হলেও ইতোমধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যে-কোনো গ্রহক ঘরে বসে মোবাইলে ব্যাংক হিসাব দেখতে পারেন। ঘরের বাইরে থাকলেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা অর্থ জমা হওয়ার বার্তা পেতে পারেন দ্রুত ও সহজে, প্রাপ্ত অর্থ তুলে নেয়া যায়। গ্রামাঞ্চলে বসে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক এজেন্টের মাধ্যমে দ্রুত এবং অল্প সময়ে আর্থিক লেনদেনের সুবিধা ভোগ করতে পারেন।

গতানুগতিক এসব ব্যাংকিং ধারার বাইরে গ্রাম-গঞ্জের ছোটোখাটো দোকানের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ গ্রামে বসেই ব্যাংকিং সেবা নেয়, সপ্তাহের সাতদিনের ২৪ ঘণ্টাই। এক ইউনিয়নে টাকা জমা দিচ্ছেন, অন্য ইউনিয়নে বা উপজেলা শহর থেকে টাকা উত্তোলন করছেন। আত্মীয়-স্বজন শহর বা বিদেশ থেকে মোবাইল একাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছেন। প্রেরকের ফোন আসার আগেই এসএমএস এর মাধ্যমে মোবাইলে টাকা জমা হওয়ার বার্তা চলে যাচ্ছে প্রাপকের কাছে। তৎক্ষণাৎ যে পরিমাণ টাকা দরকার ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র থেকে সেই পরিমাণ টাকা উত্তোলন করা যাচ্ছে। ব্যাংক এখন মানুষের দোরগোড়ায়।

তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের Access to Information (A2I) প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করা হয়। ইউএনডিপির অর্থায়নে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বত্র সমন্বিত ই-সেবা কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়েছে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যআয়ের দেশে পরিণত করা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় তাঁর কার্যালয় থেকে দেশের শেষ প্রান্ত ভোলা জেলার চরফ্যাশনে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর কুকরি-মুকরিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উন্মোচন করেন বাংলাদেশের সকল জেলার ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত তথ্য ও সেবাকেন্দ্র। সারাদেশে স্থাপিত ৪৫০১টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনৈতিক বিল্পবের সূচনা ঘটে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ এর ধারা ৭এ(ই) ও বাংলাদেশ পেমেন্ট এ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস রেগুলেসন্স ২০০৯ অনুযায়ী গাইডলাইন ইস্যু করেছে। গাইডলাইন অনুযায়ী এদেশে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শুধু ব্যাংকগুলিকেই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২৩টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি পেয়েছে এবং ১৪টি ব্যাংক ইতোমধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ২৪ ভাগ ব্যাংকিং সেবার আওতায় রয়েছে। অন্যদিকে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। শহর-গ্রামে সকল স্তরের মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক আজ দেশের আনাচে-কানাচে বিস্তৃত। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ব্যবহারকারীদের এ ব্যাপক বিস্তৃতি আমাদের দেশে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা এবং তাদের কাছে ব্যয় সাশ্রয়ী ও নিরাপদ আর্থিক সেবা সহজলভ্য করার মজবুত ভিত তৈরি করে দিয়েছে।

মোবাইল ফোনের ব্যবহার ছাড়া ব্যাংকিং এর সুবিধা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এসএমএস বা ভয়েস মেসেজ যাই প্রেরণ করা হোক তার মূলে থাকছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এখন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির (Financial inclusion) সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হিসেবে বিবেচিত। মোবাইল ফোনের এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং এর সেবাগুলির মধ্যে রয়েছে- টাকা জমাদান, উত্তোলন, পণ্য বা সেবাক্রয়ের মূল্য পরিশোধ, বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধ, বৈদেশিক আয়, বেতন ও ভাতা বিতরণ ইত্যাদি।

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এর প্রথম ও অন্যতম উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড ২০১১ সালে বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি বাংলালিংক, সিটিসেল ও এয়ারটেলের সহযোগিতা নিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা শুরু করে। বর্তমানে দেশে প্রতিষ্ঠানটির ১৫ হাজার ৭৯১টি নিজস্ব এজেন্ট লোকেশন চালু রয়েছে এবং প্রতিদিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ২ লক্ষের অধিক। চলতি বছরের মধ্যে ব্যাংকটির প্রায় ১০ লক্ষ গ্রাহকের নিকট এই সেবা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। একই বছরের জুলাই থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিকাশ বেসরকারি মোবাইল অপারেটর রবি ও গ্রামীণ ফোনের সহযোগিতায় সেবা দিচ্ছে তাদের নিবন্ধিত প্রায় সাড়ে ১০ লক্ষ গ্রাহককে।

বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনতেও মোবাইল ব্যাংকিং সোবদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৮৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী তাদের সেবার আওতাধীন। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার গ্রাহক ১২ লক্ষের অধিক। বছরে লেনদেন প্রায় ২০০৭ কোটি টাকা এবং প্রতিনিয়ত এর পরিমাণ বাড়ছে।

অনলাইন ব্যাংকিং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ATM কার্ড। এই কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহক ২৪ ঘণ্টা ব্যাংকের ATM বুথ থেকে টাকা তুলতে পারে। আবার গ্রাহক বিক্রয় পয়েন্ট (Point of sale-POS) থেকে কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটাও করতে পারে। তাছাড়া ২৪ ঘণ্টা টাকা জমা প্রদানের জন্য রয়েছে KIOSK মেশিন। আরও কিছু গ্রাহকসেবা অনলাইন সুবিধার আওতায় এসেছে, যেমন-অনলাইন Cheque Book ইস্যুর অনুরোধ। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। L/C বা ঋণপত্র SWIFT (Society for world wide inter bank financial tele-communication) এর মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে দ্রুত ও নিরাপদে সঞ্চালন হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বেশ আলোচিত। দিনদিন এই সেবার পরিধি বাড়ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, সহজে রেমিট্যান্স পাঠানো, বিল দেওয়া, এসএমএসের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় আর অল্প অল্প করে সঞ্চয়ের সুযোগ দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং গ্রহীতার আস্থা অর্জন করেছে। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তোলার ঝামেলা নেই। পণ্য ক্রয় করতে পকেটে অর্থ বহনেরও দরকার নেই। আর এসব সুবিধা দেওয়ায় দ্রুত প্রসার হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। সারাবিশ্বে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী প্রায় একশ কোটি মানুষের ব্যাংক অ্যাকউন্ট নেই। তারা কার্যত আর্থিক সেবা প্রাপ্তির সুযোগ পায় না। মোবাইল ব্যাংকিং নতুন করে আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে তাদের কাছে পৌঁছানোর। আমরা বিনিয়োগের একটি চমৎকার ক্ষেত্র হিসাবে এই খাতকে বিবেচনা করছি। এশিয়া আফ্রিকাই বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। সেবাটিকে আরো প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সচেতনতার সাথে। পিআইডি ফিচার

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.