দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী চট্টগ্রাম হলেও উন্নয়ন ভাবনায় এখানকার মানুষের চিন্তার প্রতিফলন নেই। দেড় দশক থেকে চট্টগ্রামে অপরিকল্পিত উন্নয়ন এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করলেও মানুষের উপকারে আসেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে। নতুন উন্নয়ন ভাবনায় ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণকে মূখ্য বিবেচনায় রাখতে হবে।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ‘নতুন স্বপ্ন ও নতুন বাস্তবতায় চট্টগ্রাম ভাবনা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে এসব মন্তব্য করেন বক্তারা। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া। সম্মিলিত নাগরিক ফোরামের আয়োজনে সংলাপ অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর সিকান্দার খান।
মূল প্রবন্ধে সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্ভর করছে সুষ্ঠু, টেকসই ও গতিশীল নগর উন্নয়েনের উপর। জলজট অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে চট্টগ্রাম বাসযোগ্যতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। যানজট, বায়ু, পানি, শব্দ, নদী ও খাল দখল ও দূষণ প্রকৃতিকে মানুষের টিকে থাকার জন্য হুমকিতে পরিণত করছে। উন্নয়নের সাথে যুক্ত সরকারি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অজ্ঞতা, অদক্ষতা ও দূর্নীতির কারণে ফ্লাইওভার, সেতু সহ নানান উন্নয়ন কর্মকান্ড বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আসছে না। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতে চট্টগ্রামের সকল সমস্যাকে গভীরভাবে অনুসন্ধানে নতুন পরিকল্পনায় সাজানোর আহবান জানান তিনি।
জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসন করা গেলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত চট্টগ্রাম নগরীর সংকট অনেকাংশে কেটে যাবে বলে সেমিনারে মন্তব্য করেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম বেড়ে, বেড়ে উঠা সবই চট্টগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বৃষ্টির পানিতে চট্টগ্রামের মানুষ পানিবন্দী থাকতেন। এই সময়ের মধ্যে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে কিন্তু এখনো প্রাচীন কালের মতো মানুষ নালা-নর্দমায় পড়ে মারা যাচ্ছেন। পানিবন্দী মানুষ হাসপাতালে যেতে না পেরে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে চট্টগ্রামে। বন্দরনগরীতে ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা সেবা গভীর ভাবে ভাবা দরকার।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমীর উদ্দিন বলেন, আমাদের মাতৃভূমি হীরক রাজার দেশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে হাজার হাজার কোটি ব্যয়ের কথা বলা হলেও ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে ব্যর্থ হয়েছে প্রকল্পটি। হোল্ডিং ট্যাক্সের মাধ্যমে নগরবাসীকে নাজেহাল করলেও ন্যায্য কোন সেবা দিতে পারছে না সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রাম ক্রীড়া সংস্থা সহ সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে উন্নয়নের যে তকমা পড়ানো হয়েছে নতুন বাংলাদেশ গঠনের এই সময়ে নতুন করে উন্নয়ন ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মূল কাজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হলেও সেখানে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটি। একটি বাণিজ্যিক ও বন্দরনগরী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কিভাবে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাহীন রয়েছে এটি একটি বিস্ময়। বন্দরের সহায়তায় কর্ণফুলী নদীকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা সাজাতে দখলদার ২ হাজার ৪৯২ জনকে উচ্ছেদের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পরিবেশকে প্রাধাণ্য দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে সবকিছু থাকলেও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়ন ভেস্তে গেছে। চট্টগ্রামকে ঘিরে কোন মহাপরিকল্পনা নেই। ফুটপাত মুক্ত চট্টগ্রামে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারে সে বিষয়ে সকল পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সাংবাদিক সামছুদ্দিন ইলিয়াস বলেন, ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পানি। শিল্প পানি থেকে শুরু করে সুপেয় পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। পানির সংকট নিরসনে এখন থেকে ভাবতে হবে। শত কোটি টাকা খরচ করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও সেগুলোতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় কতটুকু রয়েছে সেটি ভাবতে হবে। সমুদ্র তীরবর্তী শহরটির একটি বড় অংশই জলবায়ু শরণার্থী। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দর হলেও নাব্য সংকটে বৃহৎ জাহাজগুলো এখানে ভিড়তে পারে না। পরিবেশের পাশাপাশি পলিথিন সহ নানান বর্জ্য থেকে কর্ণফুলী নদীকে রক্ষার মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রকৃত উন্নয়নে ছাত্র-জনতাকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সুপিক আনোয়ারের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. ইমরান বিন ইউনুস, গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমী, চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজমী ও তরুণ অর্থনীতিবিদ জিয়া হাসান।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, উন্নয়ন হতে হবে সকলের জন্য, সুষম এবং টেকসই। আমাদের এখানে এতদিন যেসব উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, যেসব উন্নয়ন হয়েছে সেগুলো টেকসই না হওয়ায় বন, পরিবেশ, অর্থ, শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে। উন্নয়নের এই ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতার অভুত্থানে আসা নতুন বাংলাদেশে চট্টগ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর উন্নয়নে সকলের সমবেত অংশগ্রহণ জরুরী।